পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
8০
সংকলন

বের ক’রে সেইখানে লাগাচ্ছে ঘা, এই হচ্ছে মৃত্যুর মার থেকে মানুষকে রক্ষা করবার চেষ্টা। আর পূর্বমহাদেশ অন্তরাত্মার যে-সাধনা করেছে সেই হচ্ছে অমৃতের অধিকার লাভ করবার উপায়। অতএব, পূর্ব-পশ্চিমের চিত্ত যদি বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে উভয়েই ব্যর্থ হবে; তাই পূর্ব-পশ্চিমের মিলনমন্ত্র উপনিষৎ দিয়ে গেছেন। বলেছেন:

বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে।

যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ— এইখানে বিজ্ঞানকে চাই; ঈশাবাস্যমিদং সর্বং— এইখানে তত্ত্বজ্ঞানকে চাই। এই উভয়কে মেলাবার কথা ঋষি বলেছেন। এই মিলনের অভাবে পূর্বদেশ দৈন্যপীড়িত ও নির্জীব; আর এই মিলনের অভাবে পশ্চিম অশান্তির দ্বারা ক্ষুব্ধ, সে নিরানন্দ।

 এই ঐক্যতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কথা ভুল বোঝবার আশঙ্কা আছে। তাই যে কথাটা একবার আভাসে বলেছি সেইটে আরেকবার স্পষ্ট বলা ভালো। একাকার হওয়া এক হওয়া নয়। যারা স্বতন্ত্র তারাই এক হতে পারে। পৃথিবীতে যারা পরজাতির স্বাতন্ত্র্য হরণ করে, তারাই সর্বজাতির ঐক্য লোপ করে। ইম্পীরিয়ালিজ্‌ম্ হচ্ছে অজগর সাপের ঐক্যনীতি; গিলে খাওয়াকেই সে এক-করা ব’লে প্রচার করে। পূর্বে আমি বলেছি, আধিভৌতিককে আধ্যাত্মিক যদি আত্মসাৎ করে বসে তাহলে সেটাকে সমন্বয় বলা চলে না; পরস্পরের স্ব-ক্ষেত্রে উভয়ে স্বতন্ত্র থাকলে তবেই সমন্বয় সত্য হয়। তেমনি মানুষ যেখানে এক সেখানে তার সত্য ঐক্য পাওয়া যায়।

 সত্যকার স্বাতন্ত্রের উপর সত্যকার ঐক্যের প্রতিষ্ঠা হয়। যারা নবযুগের সাধক ঐক্যের সাধনার জন্যেই তাদের স্বাতন্ত্র্যের সাধনা করতে হবে; আর, তাদের মনে রাখতে হবে এই সাধনায় জাতিবিশেষের মুক্তি নয়, নিখিল মানবের মুক্তি।