পাতা:সংগীত চিন্তা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংগীত চিন্তা

 উপসংহারে সংগীতবেত্তাদিগের প্রতি আমার এই নিবেদন যে, কী কী সুর কিরূপে বিন্যাস করিলে কী কী ভাব প্রকাশ করে, আর কেনই বা তাহা প্রকাশ করে, তাহার বিজ্ঞান অনুসন্ধান করুন। মূলতান ইমন-কল্যাণ কেদারা প্রভৃতিতে কী কী সুর বাদী আর কী কী সুর বিসম্বাদী তাহার প্রতি মনােযােগ না করিয়া, দুঃখ সুখ রোষ বা বিস্ময়ের রাগিণীতে কী কী সুর বাদী ও কী কী বিসম্বাদী তাহাই আবিষ্কারে প্রবৃত্ত হউন। মূলতান কেদারা প্রভৃতি তো মানুষের রচিত কৃত্রিম রাগ রাগিণী, কিন্তু আমাদের সুখদুঃখের রাগ রাগিণী কৃত্রিম নহে। আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তার মধ্যে সেই-সকল রাগ রাগিণী প্রচ্ছন্ন থাকে। কতকগুলা অর্থশূন্য নাম পরিত্যাগ করিয়া, বিভিন্ন ভাবের নাম অনুসারে আমাদের রাগ রাগিণীর বিভিন্ন নামকরণ করা হউক। আমাদের সংগীতবিদ্যালয়ে সুর-অভ্যাস ও রাগরাগিণী-শিক্ষার শ্রেণী আছে, সেখানে রাগরাগিণীর ভাব -শিক্ষারও শ্রেণী স্থাপিত হউক। এখন যেমন সংগীত শুনিলেই সকলে বলেন ‘বাঃ, ইহার সুর কী মধুর’, এমন দিন কি আসিবে না যেদিন সকলে বলিবেন ‘বাঃ, কী সুন্দর ভাব’!

 আমাদের সংগীত যখন জীবন্ত ছিল, তখন ভাবের প্রতি যেরূপ মনােযােগ দেওয়া হইত সেরূপ মনােযােগ আর কোন দেশের সংগীতে দেওয়া হয় কি না সন্দেহ। আমাদের দেশে যখন বিভিন্ন ঋতু ও বিভিন্ন সময়ের ভাবের সহিত মিলাইয়া বিভিন্ন রাগ রাগিণী রচনা করা হইত, যখন আমাদের রাগ রাগিণীর বিভিন্ন ভাবব্যঞ্জক চিত্র পর্যন্ত ছিল, তখন স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, আমাদের দেশে রাগ রাগিণী ভাবের সেবাতেই নিযুক্ত ছিল। সে দিন গিয়াছে। কিন্তু আবার কি আসিবে না![১]

জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮

  1. বেথুন সােসাইটিতে বক্তৃতা। ১ বৈশাখ ১২৮৮,১১ এপ্রিল ১৮।
     ‘এই বক্তৃতাতে বক্তার মত উদাহরণ-ধারা সমর্থিত হইয়াছিল। এই বক্তৃতায় বহুসংখ্যক গান গাহিয়া কী-কী সুরবিন্যাস দ্বারা কী-কী ভাব প্রকাশিত হয়, তাহারই দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছিল। বিভিন্ন ভাবব্যঞ্জক গানের ভাবকে ও তৎসঙ্গে সুরকে বিশ্লেষণ করিয়া বক্তা নিজ মত সমর্থন করিয়াছিলেন। সে-সকল উদাহরণে কণ্ঠের সাহায্য আবক, এ নিমিত্ত সমস্তই পরিত্যাগ করিতে হইল, কেবলমাত্র ভূমিকা ও উপসংহার প্রকাশিত হইতেছে।’  —ভারতী-সম্পাদক