পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সোনার তরী
১১৩

শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা—
‘আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,
কে পরালে মালা!’

নূতন-জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক,
বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশ দিক।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে,
নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে।
জাগিয়া উঠি বৈতালিক গাহিছে জয়গান,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান।
শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি,
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে, চলিছে পুরনারী।
কাননপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা,
আধেক মুদি নয়ন দুটি ভাবিছে রাজবালা—
‘কে পরালে মালা!’

বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি—
দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি।
শয়ন-’পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়,
এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয়।
জগতে আজ কত-না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে—
একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ নাহি বলে।
বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু,
কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকিছে কুহু কুহু।
নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতালা,
শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা
‘কে পরালে মালা!’

কেমন বীর-মুরতি তার মাধুরী দিয়ে মিশা—
দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা।