পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪২
চিত্রা

সকলি ক্ষণিক খণ্ড ছিন্ন পশ্চাতে কিছু রাখে না চিহ্ন,
পলকে মিলিছে, পলকে ভিন্ন, ছুটিছে মৃত্যুপাথারে।
করুণ রোদন, কঠিন হাস্য, প্রভূত দম্ভ, বিনীত দাস্য,
ব্যাকুল প্রয়াস, নিঠুর ভাষ্য চলিছে কাতারে কাতারে।
স্থির নহে কিছু নিমেষমাত্র, চাহে নাকো কিছু প্রবাসযাত্র
বিরামবিহীন দিবসরাত্র চলেছে আঁধারে আলোকে।
কোন্ মায়ামৃগ কোথায় নিত্য স্বর্ণঝলকে করিছে নৃত্য,
তাহারে বাঁধিতে লোলুপচিত্ত ছুটিছে বৃদ্ধবালকে।
এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড, আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড
হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড ক্ষুধার দহন জ্বালিয়া।
নরনারী সবে আনিয়া তূর্ণ প্রাণের পাত্র করিয়া চূর্ণ
বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ জীবন-আহুতি ঢালিয়া।
চারি দিকে ঘিরি যতেক ভক্ত স্বর্ণবরণমরণাসক্ত—
দিতেছে অস্থি, দিতেছে রক্ত, সকল শক্তিসাধনা।
জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে ধূমায়ে শূন্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে,
লুপ্ত করিছে সূর্য চন্দ্রে বিশ্বব্যাপিনী দাহনা।
বায়ুদলবল হইয়া ক্ষিপ্ত ঘিরি ঘিরি সেই অনল দীপ্ত
কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত ফুঁসিয়া উষ্ণ শ্বসনে।
যেন প্রসারিয়া কাতর পক্ষ কেঁদে উড়ে আসে লক্ষ লক্ষ
পক্ষীজননী করিয়া লক্ষ্য খাণ্ডব-হুত-অশনে।
বিপ্র ক্ষত্র বৈশ্য শূদ্র মিলিয়া সকলে মহৎ ক্ষুদ্র
খুলেছে জীবনযজ্ঞ রুদ্র আবালবৃদ্ধরমণী—
হেরি এ বিপুল দহনরঙ্গ আকুলহৃদয় যেন পতঙ্গ
ঢালিবারে চাহে আপন অঙ্গ— কাটিবারে চাহে ধমনী।
হে নগরী, তব ফেনিল মদ্য উছসি উছলি পড়িছে সদ্য—
আমি তাহা পান করিব অদ্য, বিস্মৃত হব আপনা।
অয়ি মানবের পাষাণী ধাত্রী, আমি হব তব মেলার যাত্রী
সুপ্তিবিহীন মত্তরাত্রি জাগরণে করি যাপনা।