পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নিশ্চয় বলা যায় যে আমাদের লিখনবিশ্ব আগের মতো থাকবে না আর। বাস্তব’ শব্দটি নিছক পরিস্থিতির দ্যোতক নয়; বহুমুখী তাৎপর্যের বিচ্ছুরণকেন্দ্র হিসেবে তা অজস্র উৎস ও পরিণতির সংসোজকও বটে। প্রতিভাসিত বাস্তবতার কথা বলি যখন, ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন-সমাজতত্ত্ব প্রসূত যাবতীয় প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ তাসের প্রাসাদের মতো ধ্বসে পড়তে থাকে। এমন কী, সময় আর পরিসরের মতো সর্বজনমান্য চিন্তাবীজও অধিসময় আর অধিপরিসরের ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এতদিন যাদের সত্যভ্রম কিংবা অবভাস ভেবেছি এবং সত্য থেকে তাদের পার্থক্য-প্রতীতি বহু অধ্যবসায়ে গড়ে তুলেছি—সেই সবই কি অবান্তর হয়ে যাবে এখন? এখনকার লেখার টানা ও পোড়েন কীভাবে নির্ণীত হবে তবে! কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প দেড়শতকে যতটা পাল্টে গেছে, তাতে মনে হয়, আগামী দিনগুলিতে পরিবর্তন শব্দটা হয়তো প্রতিভাসিত বাস্তবতার সর্বাত্মক আক্রমণের বহর বোঝাতে ব্যর্থ হবে। লেখায় অবভাসের প্রাধান্য যদি সত্যকে সিংহাসনচ্যুত করে, পাঠকৃতিতে বা বয়ানে পাঠক-সাপেক্ষতার পর্যায় কি শেষ হচ্ছে? পুরনো অর্থে লেখক-সাপেক্ষতা ফিরে আসবে না হয়তো, সূত্রধার-সত্তার উপর প্রতিভাসিত আলো নিক্ষিপ্ত হবে আবার।

সময়ের বুক থেকে কারা দ্রাক্ষামোচন করে রোজ

বয়ানের মৃত্যু হল, বয়ান দীর্ঘজীবী হোক: এ তো প্রতিমুহূর্তের নিরুচ্চার উচ্চারণ। যে-অভিজ্ঞতা এইমাত্র ব্যক্ত হল, তা তো হুবহু পুনরাবৃত্ত হবে না। প্রতিটি পরিস্থিতি অনন্য, অস্তিত্বের অভিজ্ঞানও অদ্বিতীয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে বাচন মুছে যাচ্ছে, নতুন আদলে ফিরে আসছে আবার। সময়ের মহাফেজখানায় জমা পড়ছে কত অনুপুঙ্খ; গভীর মনঃ-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাদের প্রায়োগিক সামর্থ্য বদলে যাচ্ছে। স্বর থেকে স্বরান্তরে পৌছাতে সত্তার আস্তিক্য ও নাস্তিক্য নিঙড়ে নিয়ে নিজেরই প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন মাত্রা ব্যক্ত করে চলেছে সময়। যে-উৎস থেকেই উৎসারিত হোক উচ্চারণ, অতিবাহিত পথ ও পাথেয়কে মুছে না নিলে নতুন পাঠকৃতির আবির্ভাব ঘঘাষিত হয় না। যে-পরিসরে লিখনবিশ্ব জন্ম নেয়, তা নিরপেক্ষ বিষয় এবং বিষয়ীর কাছে। পাঠকৃতির জন্ম হওয়ার পরেই কেবল আমাদের ব্যাখ্যা-ভাষ্য-টিপ্পনি তাকে কোনও-না কোনও ধারণার ছাঁচ অনুযায়ী বুঝতে চায়। কিন্তু এই সবই সাধারণ সত্য। স্বয়ং সময় যখন ইন্ধন, বহু সহস্রাব্দের ধারাবাহিকতায় গ্রথিত সভ্যতা ও সংস্কৃতি যখন অভাবনীয় অগ্ন্যুৎপাতে বিদীর্ণ-কোন লেখায় ফুটে উঠবে আমাদের হাহাকার ও বিহ্বলতা, ধ্বংস-গগাধূলির মদির আত্মবিস্মৃতি ও নিমজ্জমান সত্তার আর্তি? প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকতার পথে নয়, একথা নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলা যেতে পারে। আজকের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আগামীকালের বয়ান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা করা হয়তো সম্ভব নয়; কিন্তু আরও নতুন নতুন চিহ্নের দাপট সম্পর্কে পূর্বানুমান বোধহয় করা চলে। নিশ্চয় ভাবতে পারি যে লেখার পরিসর হবে আরও বহুমাত্রিক ও অনেকান্তিক। এই পৃথিবীতে যখন কিছুই মৌলিক নয়, অজস্র স্বরের পারস্পরিক সংঘর্ষ ও সংশ্লেষণ যুগপৎ সত্য।

১০১