পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তা পুরোপুরি সত্য নয়। সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক থাক আপাতত। তবে একটা কথা নিশ্চয় বলা যায়: সংস্কৃতি মূলত সময়ের দর্পণ, সময়ের সন্তান। যদি বলি, সময়ে তো বিদূষণও থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এও বলা প্রয়োজন যে দূষণ মুক্তির স্বতশ্চল আয়োজন সময়ের ভেতর থেকেই উঠে আসে। সংস্কৃতিতে মাঝে মাঝে বিপন্নতার কালো ছায়া ঘনিয়ে এলেও দ্বিবাচনিকতার অমোঘ নিয়মে সূর্যালোকের স্বচ্ছতাই তার স্থায়ী ভাব।

 প্রতিদিন নতুন সূর্য উঠে আসে। নতুন দিন মানে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন উপলব্ধি। অভিজ্ঞতা অনবরত পাল্টে যাচ্ছে, অতএব সংস্কৃতি-চেতনাও বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। এই পরিবর্তন বিষয়-বস্তুতে ধরা পড়ে সহজে, প্রকরণে বদল ঘটে দেরিতে। জীবন-পথে চলতে চলতে আমরা সঞ্চয় করি, প্রকাশের তাগিদ অনুভব করে সেই সঞ্চয়কেই আবার পরখ করে নিই। যা কিছু আমাদের জীবনের এগিয়ে যাওয়ার গতি ও আগ্রহের সঙ্গে মানানসই নয়, তাকে ত্যাগ করি; ততটুকুই ধরে রাখি যা চলমান সময়ের সঙ্গে; থাকে। সব কিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ, অপরাজেয় মানুষ; বিচিত্র ঘটনার সঙ্গে সংঘর্ষে হয়তো ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ায়, একাধিক বিকল্প সম্ভাবনার সামনে এসে দ্বিধা ও সংশয় বোধ করে, সাময়িক পরাজয় হলেও পর্যদস্ত হয় না কখনও। গভীর-গভীরতর অন্ধকারের পর্যায়ের পরেও কতবার মানুষ তাই নতুন আলোর ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে। এই পথ চলা ও আলোয় ফেরার আনন্দ-ই হল সংস্কৃতি।

 শুধুমাত্র এই সংস্কৃতির অমেয় শক্তিতেই মানুষ পশুর চেয়ে আলাদা। মানুষের মধ্যে কিন্তু জান্তব পিছুটান রয়ে যায় যা আজকের ভোগবাদী সমাজে অত্যন্ত স্থূলভাবে প্রকট। জান্তব প্রবৃত্তির লজ্জাহীন অভিব্যক্তি ইদানীং সভ্যতার সমার্থক হয়ে পড়ছে এবং সাধারণ মানুষের চেতনাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দিচ্ছে। এটাই সবচেয়ে শঙ্কার কারণ। ব্যক্তি-সর্বস্বতার সাম্প্রতিক উৎকট পর্যায়ে অন্ধ প্রতিযোগিতা শুধু নিজেকে জাহির করার জন্যেই। এহেন পরিস্থিতিতে তাকেই বলব সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন মানুষ, যে সমষ্টি-চেতনায় দীক্ষিত হয়ে নিজেকে মুছে ফেলতে জানে। তার মানে অবশ্য ব্যক্তিত্বকে গ্রাস করা নয়, সমষ্টির সঙ্গে দ্বিরালাপে ব্যক্তির ক্রমিক ঊর্ধ্বায়ন। এইজন্যে সংস্কৃতি এক যুদ্ধের নাম, বলা ভালো, যুদ্ধ-প্রস্তুতির নাম। এই লড়াই প্রথমত নিজের সঙ্গে বলে সচেতন ভাবেই লড়াই জারি রাখতে হয়। যে-পরিমাণে মানুষ জান্তব প্রবৃত্তির হাতছানি এড়িয়ে নিজেকে উত্তরায়নের পথে সঞ্চালিত করে—ঠিক ততটাই গড়ে ওঠে তার রুচি, তার সৌন্দর্যবোধ, তার সংস্কৃতি। এইজন্যেই সংস্কৃত ভাষার এক কবির বয়ান অনুসরণ করে বলা যায়, মানুষের মনুষ্যত্বের একটি বড় প্রমাণ হল তার সংস্কৃতি-চেতনা। মানুষের মধ্যে যেহেতু অনবরত চলে পশু-সত্তার আনাগোনা, সংস্কৃতি দিয়েই মানুষের অবমূল্যায়ন রোধ করতে হয়। বিশেষত কোনও সামাজিক দুর্যোগের মুহূর্তে বহুযুগের জমে-ওঠা অন্ধকার যখন পশুর হিংস্রতা নিয়ে মানুষের পৃথিবীকে ছিড়ে-খুঁড়ে তছনছ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে—তখনই টের পাওয়া যায়, সংস্কৃতির কত প্রয়োজন। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের পরে ভারতবর্ষ যেমন টের

১১৮