পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এত পলকা যে সংকটের মুহূর্তে এদের মেরুদণ্ডের হদিশ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অথচ এদেরই হওয়ার কথা ছিল আত্ম-প্রত্যয়ে দীপ্যমান, বলিষ্ঠ ও অগ্রণী। তাহলে, সংকট বড়ো গভীরে। আস্তিক্যবাদের আস্ফালন ভারতীয় সমাজে প্রগতির সবচেয়ে বড়ো বাধা। কেননা ‘আস্তিক’ শব্দটার মধ্যে ইতিবাচকতার যত প্রতিশ্রুতি থাক না কেন, আসলে তা ফাঁপা এবং নিরর্থক। লোককথার সেই বিখ্যাত বৃত্তান্তের মতো এই মতাবলম্বীরা যে-ডালে বসেন, সে-ডালই কাটেন। কারণ, এঁরা মাটির খবর জানতে চান না কখনো; আকাশপানে তাকাতে গিয়ে কুয়োয় গিয়ে পড়েন। তাই এমনও বলা যেতে পারে, জীবনের বদলে জীবনাতিরিক্ত বিষয়ে যাদের আগ্রহ—তাদের অস্তিবোধ কোথায়? রূপরসগন্ধস্পর্শময় সুন্দর এই জগতের বদলে কল্পলোকে যারা সুখের আলয় খোঁজেন, তারাই তো নাস্তির উপাসক। সত্যের অহঙ্কার এঁরা করেন যদিও, আসলে সত্যভ্রম আর মিথ্যার মোহিনী মায়া তাদের সম্বল। অন্যদিকে যারা বলেন, জীবনাতিরিক্ত কোনো সত্তা নেই কোথাও এবং জীবনই জীবনের লক্ষ্য ও আশ্রয়—তারাই অস্তিত্বকে। প্রতিষ্ঠিত করেন। অথচ এঁদেরকে নাস্তিক বলে নিন্দা করা হয়েছে; ঝুড়ি ঝুড়ি শাস্ত্রবাক্য তৈরি করা হয়েছে নাস্তিক্যবাদের ‘শশাচনীয়’ পরিণাম দেখানোর জন্যে। জীবনকে যারা প্রাধান্য দেন, তারা হলেন নাস্তিক, আর, জীবনকে যাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন, তারা আস্তিক; এটা ব্যাসকূট ছাড়া আর কী!

 অথচ জনসাধারণের মনে আস্তিক-নাস্তিকের প্রচলিত সংজ্ঞা দৃঢ়মূল। ধর্মীয় দর্শনের সঙ্গে সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য যে কতটা অবিচ্ছেদ্য, তা এক্ষেত্রেও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। ভারতীয় সমাজের আধিপত্যবাদী বর্গ নিজেদের স্বার্থে এই খুড়োর কলটি তৈরি করেছে। ভাবাদর্শের মধ্যেও স্বভাবত প্রতাপের যুক্তিশৃঙ্খলা সক্রিয়। পৌর সমাজে রাজনৈতিক আধিপত্যের বিন্যাস যাতে কখনো শিথিল না হয়, জাতিভেদ প্রথার সঙ্গে মানানসই এবং সমর্থনকারী ভাবাদর্শ মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে! জন্মান্তর-কর্মফল-নিয়তি; সবই সামাজিক অবস্থানের নিয়ন্তা। কে কীভাবে ব্রাহ্মণ বা শূদ্র, পুরুষ বা নারী হয়ে জন্মাবে, তা অনেকটা—কিংবা সবটাই—নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে আধিপত্যবাদী ব্যক্তির ধ্যানধারণা-রীতিনীতি-ভালোমন্দ স্বীকার করে নেওয়ার ওপর। প্রচলিত সংজ্ঞায় আস্তিক হল সেই সুশীল ব্যক্তিটি, যে ভুলেও বিধিনিয়মকে প্রশ্ন করে না এবং মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া ছাড়া যার জীবনে অন্য কোনো অন্বিষ্ট নেই। তার মানে, স্রোতহীন জলাশয়ে শৈবালদাম কিংবা বদ্ধ অচলায়তনের স্তম্ভ হিসেবে বহতা কালকে এটা উপেক্ষা করে।

 নাস্তিক মানে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান সেই মানুষ যে বিনা দ্বিধায় ওই অচলায়তনের প্রাচীর ভাঙার জন্যে এগিয়ে যায়। মানুষের সার্বভৌম অস্তিত্বে তার বিশ্বাস এত বেশি যে মানুষেরই তৈরি ঈশ্বর ও ধর্ম-ভাবনার খাঁচায় বন্দী থাকাটাকে সে মনুষ্যত্বের পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। আস্তিকের মনস্তত্ত্বে যেখানে আত্ম-সর্বস্বতা খুব প্রকট, নাস্তিক সেখানে স্বচ্ছন্দে আত্মসুখের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রেরণা তাকে স্থবির ও রক্ষণশীল হতে দেয় না কখনো, এগিয়ে দেয় নিরন্তর।

১২৮