পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আস্তিকের পথ বেঁকে যায় অভ্যাসের দিকে, অতীত থেকে সর্বদা সমর্থন খোজে সে। আর, নাস্তিক যায় অভ্যাস থেকে আশ্চর্যের দিকে, সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ তাকে সঞ্জীবিত রাখে, এগিয়ে দেয় সামনে। আস্তিক স্বপ্ন দেখতে জানে না, নাস্তিক স্বপ্ন দেখে এবং দেখায়। এই স্বপ্ন সার্বভৌম জীবনের স্বতশ্চল লাবণ্যের যা কিনা নিজেতে নিজে পূর্ণ; অন্য কোনো নির্ভরতা খুঁজতে হয় না তাকে। কখনো শাস্ত্রবিধির দোহাই দিতে হয়; তার পাথেয় আস্তিকের মতো ভক্তি নয়, নির্মোহ যুক্তি। যা আছে তাকে আঁকড়ে না ধরে আস্তিক নিজের অস্তিত্বই খুঁজে পায় না; প্রচলিত প্রকরণকে বিনির্মাণ করার সাহস তার নেই। কিন্তু নাস্তিক জানে, সত্য অর্জিত হয় শুধু সাহসী বির্নিমাণে; কারণ, সত্য তো অচল অনড় নয়। প্রতিমুহূর্তে জীবনযাপন আর মননের কষ্টিপাথরে সত্যকে যাচাই করে নিতে হয়। রুদ্ধ সমাজ মানুষের ইতিহাসে এঁদো ডোবা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বারবার। তাই নাস্তিকের প্রাণশক্তি কেবল সমাজকে সচল রাখে না, দীপ্যমানও করে তোলে। কিন্তু এতেই দেখা দেয় বিচিত্র কূটাভাস। কারণ, চিরাগত যুক্তিহীন চিন্তাপরম্পরার অনুগত সামাজিক মন আস্তিক্যবাদের বাহ্যিক আড়ম্বরকে সমর্থন করে। আর, শৃঙ্খল-মোচনের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ নাস্তিকদের জন্যে বরাদ্দ থাকে শুধু কুটি ও ঘৃণার প্রত্যাঘাত।

 আগেই লিখেছি, আস্তিক ও নাস্তিকের সংজ্ঞা ও তাৎপর্যগত দ্বন্দ্ব উঁচুতলার দার্শনিক চিন্তাবিদদের মধ্যে যেভাবে আলোচিত হয়, সমাজের নিচুতলায় সেই কূট বিতর্ক দেখা যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সমাজের দিকে তাকালে বুঝতে পারি, জীবন-যাপনের তৃণমূল স্তরে এই দ্বন্দ্বের অন্য-এক ধরনের জটিল অভিব্যক্তি রয়েছে। সামাজিক মনে দার্শনিকতা খানিকটা ঝাপসাভাবে উপস্থিত হলেও দৈনন্দিন জীবনে মূলত যুক্তিহীন অভ্যাসের প্রতি বশ্যতা অনেক বেশি জোরালো ও প্রত্যক্ষ। নানা ধরনের সত্যভ্রম ও অভ্যাসের নিপুণ হাতে ছড়ানো মিথ্যা বিশ্বাসের ফাদ জনগণের চিন্তা-প্রকরণকে কার্যত অন্ধকূপে বন্দী করে রেখেছে। যুক্তি’ কথাটা আছে কেবল অভিধানে এবং বইপত্রে, জীবনে নয়। তাই যন্ত্রপ্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব রমরমার দিনে সর্বাধুনিক পণ্যসামগ্রী হিসেবে উপস্থিত আস্তিক্যবাদ। ভোতা, নিরেট, বোকা-বোকা বক্তব্যের ঠাসবুট দিয়ে দূরদর্শন-ভিডিয়ো গুণগান করছে আস্তিকদের; বাঘে-গরুতে জল খাচ্ছে একঘাটে। সর্বশেষ পুঁজিবাদী প্রকরণ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মিথ্যার স্থাপত্য; গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন-নতুন প্রত্নকথা ও কিংবদন্তি। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার অপদর্শন অসাড় করে দিচ্ছে জনমনকে। আধা-সমৃদ্ধ শহরে-জনপদে রাতারাতি গজিয়ে উঠছে শনিমন্দির, পাড়ায়-পাড়ায় হঠাৎ বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে নানা দেবতার মন্দিরের। লোকপ্রিয় হিন্দি ছবির গানের সুরে-বসানো ভক্তিগীতি রাত-নেই দিন-নেই তীব্র মাইক্রোফোন দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দিগবিদিক। মসজিদে-মসজিদে তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আজান। আশে-পাশে যারা আছে, তাদের কাছে আপন অস্তিত্ব পৌছে দেওয়ার জন্যে চলেছে

১২৯