পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেন শব্দথেরাপির কঠিন প্রতিযোগিতা। আস্তিক্যতার এই আড়ম্বরে খান-খান হয়ে ভেঙে পড়ছে সমস্ত নৈঃশব্দ্য, সব ব্যক্তিগত নির্জনতা। যে-সময়ে এখন রয়েছি আমরা, তাতে স্থূলতার উৎকট অভিব্যক্তি দেখছি ছোট-বড়ো সমস্ত কিছুতে। সংবেদনশীলতা জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক নয় যেন। তাই আস্তিক্যের বাড়াবাড়ি আমাদের পীড়িত করে না, আচরণের অন্তঃসারশূন্যতা নিয়ে একটুও মাথা ঘামাই না; দর্শনশূন্য অভ্যাসের নৈরাজ্য অজগর সাপের মতো গিলে খাচ্ছে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই দেখেও সাড়া জাগে না কোথাও। আস্তিক্যবাদ যেহেতু মানবাতিরিক্ত নির্যাস খোঁজার নামে মানুষকেই ঝাপসা করে দেয়, স্বভাবত মানুষের পৃথিবী আক্রান্ত হলেও গূঢ় মনস্তাত্ত্বিক কারণে কোথাও কোনো প্রতিবাদের ইচ্ছা জাগে না। কারণ, এই জগৎকে যদি মূল্যহীন করে দেওয়া যায়, তাহলে তার ভালো-মন্দ-উত্থান-পতন-সম্ভাবনা-আশঙ্কা কোনো কিছুতেই কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে না।

 সমাজ-মনস্তত্ত্বের গহনে যদি ঐহিককে মিথ্যা, অশুচি ও মনোযোগের অযোগ্য বলে জানি, সেক্ষেত্রে অনির্দেশ পারত্রিক ভাবনার কাছে সমর্পিত হবে বুদ্ধি। সব কিছুই যদি পূর্ব-নির্দিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ তো অর্থহীন। তার চেয়ে বরং মানিয়ে নেওয়াই ভালো। এই যে মানসিকতা, তা বহু শতাব্দী ধরে সূক্ষ্ম ও ব্যাপকভাবে গড়ে তুলেছে সামাজিক প্রতাপের কর্ণধারেরা। অবাধ পীড়ন যাতে নিরঙ্কুশভাবে বজায় থাকতে পারে, আধিপত্যবাদী বর্গ সেভাবেই প্রতিভাবাদর্শের বিপুল জালের বিস্তার ঘটিয়েছে এবং সামাজিক মনকে ধারাবাহিকভাবে সেই নাগপাশে বন্দী করে রেখেছে। আজকের এই আপাত-যান্ত্রিক দুনিয়াতেও কম্পিউটার সেণ্টার ও শনিমন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার, সন্ত্রাসবাদীর গ্রেনেড-স্টেনগান, আর.ডি.এক্স ও পুজোমিলাদ-গুরুপ্রসঙ্গ স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করছে। কোনো প্রশ্ন নেই কোথাও। কেননা আস্তিক্যবাদের মূল কথা ও প্রধান শর্তই হল পারমার্থিক অভিভাবকের কাছে প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণ। সমস্ত গান যেভাবে সমে ফিরে আসে, তেমনি আস্তিকদের সব কাজ সব চিন্তা জুড়ে থাকে একটিমাত্র ধ্রুবপদ:‘তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি।’ কর্তৃত্ব যখন নেই, কোনো কাজের উদ্যম নেবই বা কেন? সমাজে যারা নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে, তাদের কর্মফল কে খণ্ডাবে! অতএব অত্যাচারীদের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, প্রতিবাদের চেষ্টা করার প্রশ্নই ওঠে না। সমাজ-মনস্তত্ত্ব এমন নিপুণভাবে ছাঁচে ঢালাই করে নেওয়া হয়েছে যে কয়েক সহস্রাব্দ জুড়ে নিপীড়কেরা নিশ্চিন্ত। তাদের বাড়া ভাতে কেউ কোনোদিন ছাই দিতে পারবে না। ভেজা বারুদে আর যাই হোক, আগুন জ্বলে না কখননা। মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বারের চাকচিক্য বাড়ছে, সাহেব বোস্টম আর বালকবাবা আর মাচান-বাবাদের দলবল নানা ধরনের ঢাকে কাঠি দিচ্ছে, রঙিন মাদকের নেশা আর নীলস্বপ্নের কুয়াশা ডিশ অ্যাণ্টেনা দিয়ে পৌছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, নালা-বিল-পুকুর-নদী একাকার হয়ে গিয়ে পণ্য-সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে তুলছে কুণ্ঠাহীন ভোগের সাম্যতন্ত্র: এই নিচ্ছিদ্র পরিসরে কে আর কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে? আস্তিক্যবাদী মনোভঙ্গির উদার প্রশ্রয়ে নিজের ভবিষ্যৎকেও যখন

১৩০