পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে, সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এই সূত্রে পরবর্তীকালে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে ‘নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ’।

 ইহকাল-পরকাল, স্বর্গ-নরক, ঈশ্বর-জগৎ ইত্যাদি যাবতীয় বৈপরীত্যের নিঃসংশয় স্বীকৃতি আস্তিক্যবাদের মূলাধার। এতে সমাজেও স্থিরতা অটুট থাকে অর্থাৎ অক্ষুন্ন থাকে আধিপত্যবাদী বর্গের প্রতাপ। নাস্তিকদের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ এই নয় যে ওরা ঈশ্বর-পরকাল মানে না, ওরা বেদের প্রামাণিকতা স্বীকার করে না। তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারি, ওদের সবচেয়ে বড়ো অপরাধ, ওরা যুক্তিবাদী। সব কিছুতেই ওরা তর্ক করে যায় এবং প্রশ্ন না করে, পরখ না করে কিছুই মেনে নেয় না। যুক্তির সূর্যোদয়ে যেহেতু মিথ্যা বিশ্বাস ও আপ্তবাক্যের কুয়াশা মিলিয়ে যায় শূন্যে, শোষকবর্গ নাস্তিকদের সম্পর্কে আতঙ্কিত বোধ করেছে। মানুষের পক্ষে যা কিছু জ্ঞাতব্য, সমস্তই বেদে আছে: একথা যেহেতু যুক্তিনিষ্ঠ নাস্তিকেরা শিরোধার্য করে না কখনো আধিপত্যবাদীদের পক্ষে সুবিধাজনক ভাবাদর্শের কাঠামোই নড়বড়ে হয়ে পড়ে। শাস্ত্রপরম্পরায় নিঃসপত্ন অধিকার নিঃসন্দেহে নিম্নবর্গীয় ও প্রতিভাবাদর্শপন্থী জনেরা মেনে নেয়নি। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সেই পুঞ্জীভূত অপরের স্বীকৃতি নেই কোননা। বরং একরৈখিক ভাবে রচিত প্রতিবেদনে এদের অস্তিত্বও মুছে ফেলা হয়েছে; যেন ব্রাহ্মণতন্ত্র নির্দেশিত আস্তিক্যবাদই একমাত্র বিকল্পহীন সত্য। তবু, হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নাস্তিকদের উপস্থিতিকে যেহেতু একেবারে খর্ব করা যায়নি, খানিকটা সরলীকৃত ভাবে তাদের খারিজ করা হয়েছে। ভাবখানা এই, কেবলমাত্র মূখ। পাষণ্ড ও আচার-বিচারহীন ব্রাত্যজনেরা দর্শনের সূক্ষ্মতা ও মহত্ত্ব বুঝতে না পেরে নাস্তিকদের আশ্রয় নেয়। এরা করুণাযোগ্য। অত্যন্ত ক্ষতিকর অশিষ্ট দর্শনের বদ অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বলে এরা কেবল অবিদ্যা বা ভ্রান্ত জ্ঞানের পেছনে ছোটে। বৈশেষিক দর্শনের প্রবক্তা প্রশস্তপাদ তার ‘পদার্থধর্ম সংগ্রহ’ বইতে বলেছিলেন, বেদ-বহির্ভূত সমস্ত মতবাদ মিথ্যা ও বিপর্যয়ের কারণ: ‘মিথ্যাপ্রত্যয়ো বিপর্যয়ঃ। ভারতবর্ষের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ইতিহাসে বহু ওলটপালট হয়ে গেছে; কিন্তু আধিপত্যবাদীদের এই ভাবনা-পরম্পরায় কোনো ছেদ ঘটেনি। তাই পঞ্চম শতাব্দীতে প্রশস্তপাদ যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে মনুর বিশ্ববীক্ষা অনুসৃত; আবার যোড়শ শতকে অদ্বৈত বেদান্তে পারঙ্গম মধুসূদন সরস্বতী প্রস্থানভেদ’ বইতে শোষকবর্গের ভাবাদর্শের প্রতিকূল সমস্ত মতবাদকে উপেক্ষা করতে বলেছেন: ‘বেদবাহ্যত্বাৎ তেযাং ম্লেচ্ছাদি প্রস্থানবৎ পরস্পরয়াপি পুরুষার্থানুপযোগিত্বাৎ উপেক্ষণীয়ত্বমেব।’ এই উপেক্ষা আসলে খানিকটা নিজেকে চোখ-ঠারা ছাড়া আর কিছুই নয়। দেড় হাজার বছর ধরে লাগাতার চেষ্টার পরেও নাস্তিকদের যুক্তিবাদী আয়ুধকে যে পরাভূত করা যায়নি, এখানে তো তারই স্বীকৃতি পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ভাবে কোনঠাসা করার পরেও যে ঘটা করে বলতে হচ্ছে, এরা উপেক্ষণীয়—তাতেই প্রত্যাখ্যাত অপরদের বৈপ্লবিক শক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

 একদিকে শাস্ত্রবিধির চোখ-রাঙানি আর অন্যদিকে যুক্তিবিদ্যার মধ্য দিয়ে জীবনে ও

১৩৩