পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেহেতু এঁটে ওঠা যায় না, সমাজ-দেহে ‘বিদূষণ’ রোধ করার জন্য ফতোয়া জারি করেছেন, এদের সঙ্গে কথা বলবে না কেউ। কারণ, কথা বললেই বিপদ; যুক্তিপরায়ণ নাস্তিকদের জনচিত্ত আকর্ষণ করার ক্ষমতা যে অনেক বেশি! নরকেও এদের ঠাই হবে; অভিশাপ দিয়েও নিশ্চয় কাজ হচ্ছিল না, কেননা নরক তো প্রত্যক্ষ নয়। পরজন্মও চাক্ষুষ প্রমাণের বাইরে। অতএব শায়েস্তা করার একমাত্র উপায় তার্কিক নাস্তিকদের একঘরে করে দেওয়া। তর্কবিদ্যা অনিবার্যভাবে নিয়ে যায় ধর্মবিশ্বাসের উল্টোদিকে, অতএব প্রচার করা হল, তর্ক নয়—বিশ্বাসই কাম্য। সর্বকর্ম ঈশ্বরে সমর্পণই শ্রেয় কেননা তিনিই সব করাচ্ছেন: ‘অহঙ্কার-বিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে'। একথা যে কতবার কত ভাষায় বলা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আস্তিক্যবাদের শেষ পর্যায়ে ব্যক্তিত্বের বিলুপ্তি চূড়ান্ত; আর, নাস্তিক্যবাদে ঘটে ব্যক্তিত্বের সার্বিক প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠা কিন্তু শাসকবর্গের পক্ষে আশঙ্কার কারণ। তাই ব্যক্তিকে লুপ্ত করে দেওয়ার জন্যে একদিকে পশুশক্তির আস্ফালন আর অন্যদিকে আস্তিক্যবাদের প্রকরণ অর্থাৎ ধর্মমোহ ছড়িয়ে দেয় ওরা। সাহিত্যের ভাষায় এই তত্ত্ব চমৎকার প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে। ওখানে কেনারাম গোঁসাই খুব তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছে: ‘বাবা, দন্ত্য-ন পাড়া যদিও এখনো নড়নড় করছে, মুর্ধন্য-ণরা ইদানীং অনেকটা মধুর রসে মজেছে। মন্ত্র নেবার মতো কান তৈরি হল বলে। তবু আরও কটা মাস পাড়ায় ফৌজ রাখা ভালো। কেননা নাহংকারাৎ পরো রিপুঃ। ফৌজের চাপে অহংকারটার দমন হয়, তারপরে আমাদের পালা।’ (জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ, ষষ্ঠ খণ্ড পৃ ৬৬৪) একথাটাই একটু অন্যদিক দিয়ে স্পষ্ট করে বলেছে চাবুকের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত বিশু: ‘চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি।” (তদেব: ৬৮২)

 সমাজপতিরা কখনো তাদের তৈরি শৃঙ্খলা ও কাঠামোর পক্ষে কোনো ধরনের ব্যতিক্রম সইতে পারে না। পরশ্রমজীবীবর্গ টিকে থাকে সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনীর অবিচল অবস্থানের ওপর। সব কিছু যন্ত্রের মতো নিখুঁত পারিপাট্য নিয়ে যদি না চলে, তাহলে তাদের অস্বস্তির আর শেষ থাকে না। স্বভাবত অস্বস্তির কাটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা তাদের করতেই হয়। নিয়মমাফিক সবকিছু ঠিকঠাক চলছে এবং চলবে, এই বিশ্বাসে ফাটল ধরলে মুশকিল। অতএব তর্ক নয়, সমর্পণ। নাস্তিকতা তাদের কাছে নৈরাজ্যের বিভীষিকা। একদল বিনা প্রশ্নে পরিশ্রম করে যাবে, আরেক দল সেই পরিশ্রমের ফল ভোগ করবে। এই সরল পন্থা সম্পর্কে যারা আপত্তি করে, তারা নৈরাজ্যবাদী-পাষণ্ড এবং নাস্তিক। এইজন্যে মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথি ধর্ম-বিশ্বাসহীন তার্কিকদের সম্পর্কে ভৎর্সনার সুরে বলেছেন: ‘হেতুকাঃ নাস্তিকাঃ নাস্তি পরলোকঃ নাস্তি দত্তং, নাস্তি হুতম ইত্যেবং স্থিতপ্রজ্ঞাঃ’ আর, টীকাকার কুল্লুক ভট্ট লিখেছেন—‘হৈতুকাঃ বেদবিরোধিতর্ক-ব্যবহারিণঃ’ অর্থাৎ যারা হেতু-শাস্ত্রবিদ, তারা কেবলই বেদবিরোধী

১৩৫