পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লিটল ম্যাগাজিন নামক শমীবৃক্ষ

 আমরা লক্ষ করছি, ছোট পত্রিকা সফল হলেই ছোট থাকছে না আর। এই তথ্য নিছক তথ্য নয়, হয়ে দাঁড়াচ্ছে বড়ো মাপের সমস্যা। লিটল ম্যাগাজিন গোত্রপরিচয় হারিয়ে পরিণত হচ্ছে মেগা-ম্যাগাজিনে। তখন তার চরিত্রেও আমূল রদবদল ঘটে যাচ্ছে। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলেন, মেদবৃদ্ধি তো কায়ায় হয় না কেবল, মগজেও হয়ে থাকে। ঈষৎ রাবীন্দ্রিক ঢঙে বলা যেতে পারে, চিরপুরোনো চাদ, চিরদিবস এমনি থাকো, এই তো আমার সাধ।

 না, কথাটি মোটেই ঠাট্টা-তামাসার নয়। কলকাতায় প্রমা, অনুষ্টুপ, এক্ষণ, অমৃতলোক, বিভাব, হাওয়া ৪৯, এবং এই সময়, এবং মুশায়েরা ইত্যাদি কাগজের গোত্রপরিচয় মূলত অভিন্ন ছিল। কিন্তু বিবর্তনের পথে এরা আজ পরস্পর থেকে (এবং আসলে নিজের উৎস-স্বভাব থেকেও) কার্যত আলোকবর্ষ দূরত্বে চলে গেছে। কোনো-কোনো সম্পাদক প্রকাশ্যে লিটল ম্যাগাজিনের পারিভাষিক ও ইতিহাস-নির্ধারিত পরিচয় নস্যাৎ করে এর প্রেরণা ও সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শকে অস্বীকার করছেন। কেননা সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ঢালাও বদান্যতায় তাদের প্রাক্তন-লড়াই এখন তাদের নিজেদের পক্ষেই অস্বস্তিকর এবং বিস্মৃতিযোগ্য স্মৃতি। বরং পণ্যায়নের যাবতীয় যুক্তিশৃঙ্খলা মেনে নিয়ে পাদপ্রদীপের আলো ভাগ করে নেওয়ার জন্যে অশোভন ব্যগ্রতাই স্বাভাবিক। শ্লোগান এখন একটাই: যে-খেলার যে-নিয়ম!

 কী বলব একে! ছোট পত্রিকার গভীর গভীরতর সংকট, নাকি, মিডিয়া-শাসিত টাকা-মানুষদের মৌল ব্যাধি! কেন আজ ‘কার আগে প্রাণ কে করিবে দান তারি লাগি কাড়াকাড়ি’ এত প্রকট হয়ে পড়েছে? ছোট পত্রিকাকে সিড়ি আর মেগা-ম্যাগাজিনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আনন্দলোলাকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে গোপন ও প্রকাশ্য মেধাবিক্রয়ের আয়োজন কিসের ইঙ্গিত? এ বিষয়ে আরও কথা বলার আগে সমস্যার অন্য এক দিকের প্রতি তর্জনি সংকেত করা যেতে পারে। প্রশ্নহীন আন্তরিকতা নিয়ে যথেষ্ট ক্লেশ সয়ে চেয়ে-চিন্তে নবীনতম কিছু লেখা একসঙ্গে ছাপিয়ে দেওয়াই কি শেষ কথা? তারুণ্যের স্পর্ধা, জগৎ-সংসারের প্রতি সরব তাচ্ছিল্য, দুজন বা তিনজন মিলে গোষ্ঠী তৈরি, বইমেলা এবং এজাতীয় সামূহিক উপস্থিতিতে উদ্ভট আচরণ করে নজর কাড়ার চেষ্টা: এসবের নীটফল কি লিটল ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য আন্দোলন! কয়েকটি এলোমেলো কৃশকায় সংখ্যা প্রকাশ করতে করতে কোদল তুঙ্গে উঠে যায় অবধারিতভাবে এবং অকালমৃত্যু ঘটে সেই পত্রিকার। প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ কিছুই তাতে ভালোভাবে দানা বেঁধে ওঠে না।

 কেন কাগজ করছি, এবিষয়ে স্পষ্ট ধারণা শুরুতে হয়তো অনেকের থাকে না। কিন্তু

১৩৯