পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বর্গের প্রতাপ-পঞ্জীয়নের চতুর কৃৎকৌশল, লোকায়ত প্রাকৃত অনুভবের স্পন্দনে জেগে উঠছে এতদিনকার প্রান্তিকায়িত চেতনা-ভাষা-অভিজ্ঞতা। লিটল ম্যাগাজিন ধারণ করছে। এইসব প্রতিস্রোতের আকল্পকে।

 এইজন্যে যদি সাহিত্যসৌধের নোনা পলেস্তারা খসে পড়ে যায় তো যাক। তার বদলে জেগে উঠছে কিনা আটপৌরে কিন্তু সজীব প্রাণের স্ফুলিঙ্গরূপী ‘লেখা’ এবং চিহ্নায়ন সম্পৃক্ত নবীন লিখনপ্রণালী—লিটল ম্যাগাজিনের পাঠক হিসেবে একমাত্র তা-ই আমাদের বিবেচ্য। এই লেখার মধ্যে লেখক-সত্তার বদলে সূত্রধার-সত্তা যদি প্রবলতর হয়ে ওঠে, তাতে সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ক্লান্তি-অবসাদ-নিরক্ত ধূসরতা থেকে সরে আসার পথ খুঁজে পাই। অন্তত যেসব পড়ুয়ার মানস-জীবনে কোনো বিবর্তন নেই অর্থাৎ যাদের শৈশব কাটে না কখননা, তাদের মনোরঞ্জনের দায় বইছে লেখা। এদের মুখে চুষিকাঠি ধরিয়ে দেওয়ার মহান ব্রত পালন করেন যেসব সাহিত্যিকেরা, তাদের দলে না ভিড়ে ওই লেখাপত্রের পতাকা শক্ত মুঠোয় ধরে রাখছেন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরা। তারা মধ্যবিত্তের ফাপা, তরল, দায়িত্ববোধহীন দুঃখসুখের পাঁচালি ছেপে এত কষ্টে বের-করা পত্রিকার অমূল্য পাতাকে নষ্ট করবেন।, এটাই আজকের দিনের বড়ো ভরসা। নিসর্গের সরকার আশরাফ, লিরিকের এজাজ ইউসুফী, দ্রোণাচার্যের শিমূল আজাদ, অমৃতলোকের সমীরণ মজুমদার, উত্তরাধিকারের অমিত দাস, হাওয়া ৪৯-এর সমীর রায়চৌধুরী, কালিমাটির কাজল সেন, মধ্যবর্তীর বিশ্বরূপ দে সরকার, দ্যোতনার গৌতম গুহরায়, শরিকের বিশ্বজিৎ চৌধুরী, একবিংশের খোন্দকার আশরাফ হোসেন, কবিতীর্থের উৎপল ভট্টাচার্য আজ আর বিচ্ছিন্ন কটি নাম নন; এঁদের মতো আরও কয়েকজনের সমবায়ী উদ্যোগে গড়ে উঠেছে প্রতিভাবাদর্শের শানিত আয়ুধ। এর চেয়ে বেশি ইতিবাচক সংকেত আর কী হতে পারে। এসময় অনেকার্থদ্যোতনার, এসময় বহুস্বরসঙ্গতির। এই দায়িত্ব পালন করছে যুদ্ধরত লিটল ম্যাগাজিনেরা, বিজ্ঞাপনধন্য পণ্যসাহিত্যের সেবাদাসদের আধা-ঔপনিবেশিক আড়তগুলিতে অর্ডারি মালের বেচাকেনা দিনদিন মিইয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যবসাদারেরা কি সহজে হার মানতে পারে? তাই এরা নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকিয়ে দেয়। অর্থাৎ ছোট পত্রিকার শিবির ভাঙার চতুর আয়োজন করে।

 বস্তুত এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পৌর সমাজের ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা রাজনৈতিক সমাজে যেভাবে লজ্জাহীন ভ্রুক্ষেপহীন শিবিরবদল রেওয়াজে পরিণত হয়েছে, তাতে তাৎক্ষণিক সুবিধা পাওয়ার লোভ-ই হয়ে উঠছে জীবনযাপনের মুখ্য আধেয়। যেসব লিখিয়েরা মূলত চলতি হাওয়ার পন্থী, স্রোতে গা ভাসানোর চেয়ে বেশি কোনো দায় স্বীকার করতে তারা নারাজ। এরা কেবল তথ্যের খোলস দেখে তৃপ্ত; যদি ওই খোলস রঙিন ও চকচকে হয়ে থাকে, তাহলে একেই সাম্প্রতিকতার পরাকাষ্ঠা ভেবে এরা উল্লসিত। জীবনে কোনো সংকেত খোঁজা বা তাৎপর্য আবিষ্কার করার বৃথা হয়রানি এরা পছন্দ করেন না। যৌবনে অন্যায় ব্যয়ে বয়সে কাঙালি হতে কোনো আপত্তি নেই এদের, কেননা নিজেদের পর্বতপ্রমাণ মূঢ়তা এরা ঢেকে রাখেন

১৪১