পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

করেননি। এমন কি, প্রচলিত অর্থে জনপ্রিয়তার মোহকে অস্বীকার করে জনতার উপর চাপিয়ে দেওয়া রুচি, বাস্তবতা ও ন্যায়বোধকে আক্রমণ করেছেন। তাদের কল্পনা, আবেগ ও চিন্তা, যুক্তি ও প্রকল্পনা অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা থেকে উৎসারিত হয়ে ভাষাসংস্কার ও সাহিত্যসংস্কারকে যেন ভেতর থেকে ছুরিকাঘাত করেছে। সভ্যতার নামে মানুষের তুমুল মৃত্যুপরম্পরাকে এরা অস্বীকার করতে চেয়েছেন লিটল ম্যাগাজিনের আশ্রয়ে। সমস্ত কোলাহলের উল্টোমুখে দাঁড়িয়ে এমন-এক নতুন বহুত্বময় কণ্ঠস্বরের জন্ম দিতে চায় এই পত্রিকাগুলি যা মৃত্যুপীড়িত সভ্যতার পক্ষে দর্পণ হবে না কেবল, গড়ে তুলবে প্রতিবাস্তবতা ও প্রতিসন্দর্ভের আদল।

 ছোট পত্রিকার মূল লড়াই এইখানে যে, সাহিত্যকে নিছক মুনাফাখোরদের পণ্যে রূপান্তরিত করাকে প্রতিহত করাই তার লক্ষ্য এবং সেইসঙ্গে আধিপত্যবাদীদের আসল চেহারাটা ধরিয়ে দেওয়াই তার দায়। ছোট পত্রিকায় যারা লেখেন, তারা রুগ্ন সমাজের যথাপ্রাপ্ত মূল্যবোধকে বারবার প্রশ্নে বিদ্ধ করেন, ব্যবচ্ছেদ করেন, আক্রমণ করেন। সততা ছাড়া সর্বব্যাপ্ত প্রচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে যেহেতু লড়াই করা যায় না, ছোট পত্রিকার প্রতিটি যোদ্ধাই সেহেতু লেখাকে যুদ্ধ বলে মনে করবেন—এই হল ন্যূনতম চাহিদা। গ্রিক প্রত্নকথার সিসিফাসের মতো নিঃসঙ্গ ও একক অভিযাত্রী হওয়ার জন্যে তাদের তৈরি থাকতে হয় এবং বারবারই হয়তো নতুন করে সূচনাবিন্দুতে ফিরে গিয়ে কঠিন চড়াই ভেঙে দুর্বহ পাথরকে ঠেলে তুলতে হয় উপরে। কোনো ছক অনুযায়ী তা হতে পারে না। ফলে ছোট পত্রিকাকে বারবার ছক ভেঙে ফেলতে হয়, গড়তেও হয় আরও একবার তা ভাঙার জন্যে। এ বিষয়ে সর্বতোভাবে লিটল ম্যাগাজিনেরই লেখক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনার প্রতিনিধি সুবিমল মিশ্র লিখেছেন:‘প্রতিষ্ঠান একটি ব্যাপক শক্তি, বিভিন্ন কেন্দ্রে তার ডালপালা ছড়ানো। প্রতিষ্ঠান সবসময়ই মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিরোধী। তার উদ্দেশ্য মুনাফা লোটা এবং যেন তেন প্রকারে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীকে করায়ত্ত করা। পাঠককে শিল্প-সচেতন করা নয়, তার মনোরঞ্জন করা। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেই প্রতিষ্ঠান চায় সমস্ত রকম স্বাধীন অভিব্যক্তি, প্রকৃত সত্যের প্রকাশ বন্ধ করতে। তাদের হাতে বিজ্ঞাপন যন্ত্র, সমস্ত রকমের প্রকাশমাধ্যমগুলি, আর মূলত এই বিজ্ঞাপনের সাহায্যে সে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

 প্রতিষ্ঠানের এই মারাত্মক সর্বগ্রাসী চরিত্র এইজন্যেই ঘৃণ্য যে তা তথাকথিত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একটা তাসের প্রাসাদ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এর আসল লক্ষ্য মানুষের মানবিক নির্যাসটুকু শুষে নেওয়া। একদিকে প্রবল দৈত্যের মতো তার পরাক্রম আর অন্যদিকে মনোলোভন মুখোশের ও প্রসাধনের শিল্প। লিটল ম্যাগাজিনের যোদ্ধারা এতে ভয় পান না। কারণ রাজা যে আসলে উলঙ্গ, সে-খবর তাদের জানা। কিন্তু এও ঠিক যে, বিজ্ঞাপনের চাতুর্যে অনবরত সব পেয়েছির রঙিন দেশের হাতছানিতে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। প্রতিভাবাদর্শের ঔদ্ধত্যকে যে রোখা সম্ভব কেবলমাত্র ভাবাদর্শের শক্তিতে, একথা ভুলে গিয়ে চটজলদি নামী-দামী হওয়ার জন্যে

১৪৪