পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সেইসব বিভ্রান্ত লিখিয়েরা আত্মসমর্পণ করে বসেন। এবং, সেই মুহূর্ত থেকে স্বাধীন লিখিয়ে থেকে তারা পরিণত হয়ে যান ভাড়াটে কলমচিতে। ভুলে যান, কয়েক বছর স্রোতে গা ভাসিয়ে চলতে পারলেও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি তাদের মরা ইদুরের মতো ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। ষাটের দশকের শাস্ত্রবিরোধী গল্পকার বা প্রথাবিরোধী কবিদের বেশ কয়েকজন স্বধর্মচ্যুতির মাশুল কীভাবে দিচ্ছেন, এর নজির চোখের সামনে রয়েছে। এরা এবং এঁদের আগে ও পরে আরও কবি-লিখিয়েরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটেছেন এবং অবধারিতভাবে কয়েক বছর যেতে-না-যেতে হারিয়ে ফেলেছেন তাদের সৃষ্টির উত্তাপ ও ব্যক্তিত্বের অভিজ্ঞান। এ থেকে ছোট পত্রিকার অনেক কিছু শেখার আছে। কিন্তু, অত্যন্ত পরিতাপের কথা, ইদানীং জোয়ারের বদলে ভাটার টান যেন অনুভূত হচ্ছে। চোরাগোপ্তা পথে আপস করতে করতে কেউ কেউ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন দু-নৌকায় পা রেখে চলতে। গাছের খাওয়া এবং তলারও কুড়োনো চলেছে এক সঙ্গে, বিনা দ্বিধায়। যে-কারণে জন্ম হয়েছিল লিটল মাগাজিন নামক প্রতিজ্ঞার, তাই যেন নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে। বিশ্বপুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক আয়ুধ আধুনিকোত্তরবাদকে প্রসঙ্গহীনভাবে রপ্ত করতে গিয়ে হাঁসজারু মানসিকতা ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠেছে। এই উপমহাদেশ, বিশেষভাবে বাঙালির ভুবন, পুঁজিবাদী। রূপান্তরের প্রমোদভ্রমণে সামিল হতে যত উৎসুক হয়ে উঠছে—লিটল ম্যাগাজিনের সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে তত।

 এ সময় পশ্চিম বাংলায় সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিচিত্র সন্ধিলগ্নে পৌঁছেছে। একদিকে ফাপা হয়ে পড়ছে স্পর্ধিত ইমারতগুলি, আবার অন্যদিকে গড়ে উঠছে। নতুন-নতুন প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র। একেক ক্ষেত্রে একেক মুখোশ। এদের দ্বন্দ্বে আরক্ত সাম্প্রতিক সাহিত্য। ছায়া ও প্রচ্ছায়ায় আকীর্ণ হয়ে অকারণ জটিলতা যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে যেন সৃষ্টির বৈচিত্র্য। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন নামক প্রতিষোতবাহী আন্দোলনের। লক্ষ্যভ্রষ্ট ও উদ্দেশ্যহীন পরিক্রমা ক্রমশ দিনের নিয়মে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা যখন বিকল্প সন্দর্ভ ও বিকল্প নন্দনের আশ্রয়ভূমি হয়ে ওঠার কথা ছিল, তখন পোক বিনিময়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে প্রতিবাদী চলনের স্পৃহা। অতি অল্পেতে তুষ্ট হয়ে যাচ্ছেন সেইসব আশুতোষ লিখিয়েরা, বছর ত্রিশেক আগে বিপুল সামাজিক ও রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে যাঁদের অগ্নিস্নান সম্পন্ন হয়েছিল। এঁদের দেখাদেখি তরুণতম লেখকেরাও, প্রস্তুতিপর্ব শেষ হওয়ার আগেই, যুগপৎ দুধ ও তামাকে অভ্যস্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটি শিখে নিচ্ছেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে, লিটল ম্যাগাজিন যেমন প্রতিবাদী শক্তির প্রতীক তেমনি বহুধা-বিভক্ত হয়েও প্রতিষ্ঠান মূলত মানবিক নির্যাস শোষণকারী অপশক্তির অন্য নাম। বাঘের হিংস্রতা, কেউটের বিষ, শেয়ালের ধূর্ততা এবং যন্ত্রগণকের দক্ষতা সমন্বিত হতে দেখি প্রাতিষ্ঠানিক প্রতাপের কৃৎকৌশলে। এইজন্যে এ সম্পর্কে শৈলেশ্বর ঘোষের মন্তব্য আমাদের আলাদা মনোযোগ দাবি করে:

 ‘জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাই হবে সাহিত্য। সাহিত্য আমাদের কাছে কল্পনাবিলাস

১৪৫