বা ভাববিলাস নয়। জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা দিয়ে আমাদের সাহিত্যের শুরু, শেষ হবে, আমরা মনে করি, প্রত্যেকের জীবনের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে। চেতনার ক্রমপ্রসারণ প্রক্রিয়ায় দেখা দেবে এই সম্ভাবনা। এটা বুঝতেই হবে যে একজন স্রষ্টা আর একজন সাহিত্যব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য একজন ভ্রমণকারী ও একজন দারোয়ানের পার্থক্যের সমান!’ (প্রতিবাদের সাহিত্য: পৃ ৯৪)
৩
শৈলেশ্বর যখন বলেন ‘জীবনের প্রকৃত বাস্তবতার কথা, স্পষ্টত তা প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য-সাহিত্যের মেকি বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করে তোলে। হাংরি প্রজন্মের দর্শন যদিও এতে ব্যক্ত হয়েছে, আসলে তা খাঁটি লিটল ম্যাগাজিনের অন্বিষ্ট। জীবনকে যে অপশক্তি খাঁচায় বন্দী করতে চায়, তার লক্ষ্যই হল মিথ্যার আবর্জনাস্থূপের সম্প্রসারণ। এর মোকাবিলা করতে চায় যারা, তাদের সমিধ সংগ্রহের জন্যে কোনো বানানো বাস্তবতায় গেলে চলে না। জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে রসদ নিয়ে তাদের বিনির্মাণ করতে হয় যাবতীয় সন্ত্রাস ও রুদ্ধতার কারিগরিকে। মানুষের নিষ্কর্য হিসেবে গড়ে তুলতে হয় সেই নবীন চেতনাকে যা কেবলই যথাপ্রাপ্ত পরিসরকে পুনর্নির্মাণ করে। চেতনা অনবরত সম্প্রসারিত হয় যখন, স্থবিরতার উল্টো মেরুতে গতি তীব্র দ্যুতি অর্জন করে নেয়। মানুষের হওয়া আর হয়ে ওঠা কত যে সম্ভাবনায় স্পন্দিত, সেই বার্তা পৌঁছে দেয় সৃষ্টি-প্রক্রিয়া। রোলা বার্তের কথায়, এই উদ্দেশ্য হল ‘To undo our own reality under the effect of other formulation!’ প্রতিষ্ঠানের চক্রান্তকে ওই সম্ভাবনার নিরন্তর কর্ষণ করেই প্রতিহত করতে পারেন ছোট পত্রিকার লড়াকু যোদ্ধারা। শৈলেশ্বর লিখেছেন: ‘প্রতিষ্ঠান যা প্রত্যাখ্যান করে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তাই গ্রহণ করে, প্রতিষ্ঠান যা ঘৃণা করে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তাতেই আনন্দ পায়, প্রতিষ্ঠান যা ধ্বংস করতে চায় প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তাই লালন করে, প্রতিষ্ঠান যা পাপ মনে করে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী তাকেই ধর্ম মনে করে, প্রতিষ্ঠানের থাকে পোষা কুকর, প্রতিষ্ঠানবিরোধীর থাকে ক্ষুধার্ত বাঘ, প্রতিষ্ঠানের কাছে যা যৌনতা প্রতিষ্ঠান-বিরোধীর কাছে তাই ভালোবাসা, প্রতিষ্ঠানের কাছে যা জীবন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধীর কাছে তাই মৃত্যু। প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা করে বিদ্রোহীর দুর্বলতা খুঁজে নিয়ে তাকে ইতিহাসে ঢুকিয়ে দ্যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠান-বিরোধী এমন অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করে যা প্রতিষ্ঠানের মাথায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় এবং বুর্জোয়া ইতিহাস তাকে ভয় পায়।’(তদেব)
সুতরাং, দুটো-চারটে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ছাপিয়ে দিয়ে লিটল ম্যাগাজিনের দায় শেষ হতে পারে না। সমস্ত প্রচলিত নান্দনিক-সামাজিক অভ্যাস ও সংস্কারকে প্রত্যাহ্বান জানায় না যেসব লেখাপত্র অর্থাৎ যা আধিপত্যবাদী বর্গের নিশ্চিন্ত নিরুদ্বিগ্ন উদ্ধত অবস্থানে অস্বস্তি জাগাতে পারে না—ছোট পত্রিকার দুর্মূল্য পাতা ভরানোর কোনো অধিকার তাদের নেই। এর মানে এই যে, কেবলমাত্র প্রতিবাদ বা এমন কি বিদ্রোহ করে ক্ষান্ত হলে চলবে না, ছোট পত্রিকাকে বিস্ফোরক উত্তাপের কেন্দ্রও হয়ে উঠতে হবে।