পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আরেকটি ইট যোগ করবে। অতএব ছোট পত্রিকা জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কেবলই প্রশ্ন তুলে ধরুক, পড়ুয়াদের জন্যে অস্বস্তি তৈরি করুক। সাহিত্য করা’ কথাটার মধ্যে যে সামন্তবাদী দাতা-গ্রহীতার বিভাজন ইঙ্গিতে রয়ে যায়, তাকে ভেঙে দিয়ে জীবন ও জগতের সাহিত্য-হওয়া লক্ষ করুন পড়ুয়ারা। বলা ভালো, তারা নিজেরা ওই প্রতিবেদন-নির্মিতির অবিভাজ্য অঙ্গ হয়ে উঠুন। কেবলমাত্র এভাবেই গড়ে উঠতে পারে বিকল্প নন্দন, বিকল্প সন্দর্ভ, বিকল্প অনুভূতির পরম্পরা।

 কথা হলো, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতো স্বেচ্ছাব্রতী ইদুর সমাজে পাওয়া ভার। ভক্ষকের সঙ্গে ভক্ষ্যের মৈত্রী অসম্ভব, এমন কি আপাত-মৈত্রীও আত্মহননের মূখ উচ্ছ্বাসমাত্র। আজকের বাঙালি সমাজ যাদের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি চক্রান্তের চাতুর্যে শতধা-বিচ্ছিন্ন এবং প্রতিটি একক সত্তা অন্য একক সত্তা থেকে দ্বীপের মতো সুদৃঢ় ও অনধিগম্য, তাদের জটিল গ্রন্থনাকে শনাক্ত করাই লিটল ম্যাগাজিনের সাহিত্যকৃতি। শুধুমাত্র সপ্রতিভ ভঙ্গি দিয়ে যেসব বন্ধুরা অন্যের চোখে ধুলো দিতে ও ঠুলি পরাতে চান, তারা আসলে যে নিজেদের আধিপত্যবাদী বর্গের ঢাকের কাঠিমাত্র করে তোলেন—এ বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নেই। ছোট পত্রিকার নামে আত্মপ্রত্যাখ্যানের এই মারক অভ্যাসও যে অনেকে আয়ত্ত করে নিয়েছেন, তা অস্বীকার করব কীভাবে! নিসর্গ বা অমৃতলোক বা উত্তরাধিকার এই সত্য যদি জেনে থাকেন, তাহলে তারা কাগুজে বাঘদের প্রতি তর্জনি সংকেতের দায়িত্ব নিন। শুধু কি তাই! বিশ্বজুড়ে আজ মৌলবাদী প্রতিক্রিয়ার বাড়বাড়ন্ত। তারই সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষত বাঙালির ভুবনে, পেছনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার তাড়নায় সাংস্কৃতিক মৌলবাদ ক্রমশ পরিশীলিত ছায়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। পশ্চিম বাংলায়, বাংলাদেশে এবং বাঙালির অন্য ভূগোলেও ঐতিহ্য-মূলকতার নামে কিছু কিছু লিটল ম্যাগাজিন অতীতমোহ বিস্তার করতে চাইছে। অবধারিত ভাবে ধর্মীয় কুহক তাতে পুনর্বাসন পেয়ে যাচ্ছে। এই কি অপ্রাতিষ্ঠানিকতার নিদর্শন! সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে হিংস্রতম ও কুটিলতম অচলায়তনে ফিরে যাচ্ছেন যাঁরা সূক্ষ্ম ও কৃকুশলী পরিশীলনের আড়ালে-তাদের ইতিহাসবোেধ ঝাপসা। অন্তত বাঙালির হাজার বছরের উত্থান-পতন অগ্রগতি-পশ্চাত্বর্তন স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ আত্মহনন-পুনর্নির্মাণ থেকে কোনো পাঠ এরা নেননি। সবচেয়ে বড়ো কথা, সব ধরনের প্রতিষ্ঠানিকতা ভেঙেই যে বাঙালি চিরকাল বিকল্প পথ, পাথেয় ও গন্তব্য গড়ে নিয়েছে—এই মূল সত্য তাদের উপলব্ধিতে নেই। সমস্ত দিক দিয়ে আজ আমরা ক্রান্তিকালের আবর্তে। এ সময় খাটি লিটল ম্যাগাজিনের পতাকাবাহকেরাই কেবল আমাদের পৌছে দিতে পারেন নতুন সম্ভাবনার সহস্রাব্দে। তারা যদি ব্যর্থ হন, বাঙালির লেখা-লেখা খেলা থেকে নির্বাসিত হবে আবহমান বাংলা।

 লিটল ম্যাগাজিনের যারা শত্রু, তাদের জীবনেরই শত্রু বলে অনায়াসে শনাক্ত করা যায় আজ। আমাদের দৈনন্দিন প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে ধ্বংসস্তুপে। আমরা যত নগ্ন

১৪৮