পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হচ্ছি, তত তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অবসাদ আর আত্মপ্রতারণা। কিন্তু উল্টো দিকে শত্রুপক্ষের চাতুর্য বাড়ছে, পরিশীলন বাড়ছে, মুখোশের কারুকাজ বাড়ছে। কোনো সন্দেহ নেই যে, অর্ধেক দশক যেতে না যেতে ভেঙে যাচ্ছে সংঘ। বড়ো বেশি একক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার আয়োজন। ছোট পত্রিকার ভেতর থেকেই তাকে চুরমার করে দেওয়ার কসরত। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে নিজেরা খুদে খুদে প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চাইছি আমরা। লিটল ম্যাগাজিন মানে বিকল্প পথ-পাথেয়-গন্তব্য এবং বিকল্প দর্শন-নন্দন-গ্রন্থনা: এই গোড়ার কথাটা অনেকেই আজ মনে রাখছি না। তবে কি সাহিত্যের মুষলপর্ব এসে গেছে, যখন, প্রত্যেক সহযাত্রীর মুঠোয় ধরা পাটকাঠিও বল্লমে রূপান্তরিত হবে! প্রয়োজন কি সত্যি ফুরিয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের? এবার তাহলে লেখা হবে সমবেত এপিটাফ, কারণ, আন্দোলন হিসেবে তার মৌল অস্তিত্ব আজ অস্বীকৃত। এখন কেবল অশ্মীভবনের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্যে নিরাবেগ প্রতীক্ষা।

 অর্থাৎ গণশত্রুদের পোয়াবারো। তাদেরই উদ্যত খড়গের নিচে নতশির হবে জীবনের সংস্কৃতি! এরা মিথ্যা দিয়ে সত্যকে বলাৎকার করাবে, ক্রয়মূল্য দিয়ে ঠিক করে দেবে অস্তিত্বের উপযোগিতা, ঘাতকের বেপরোয়া হিংস্রতার কাছে যাবতীয় মানবতাকে কুঁকড়ে যেতে বাধ্য করবে। লিটল ম্যাগাজিনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া কি এই অনিবার্য ভবিতব্য নয়? নিশ্চয় সরকার আশরাফ বা সমীরণ মজুমদার বা তাদের অন্য সহযোদ্ধারা এই আত্মবিলয় মেনে নেবেন না। বরং তারা আরও স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করবেন, ছোট পত্রিকার একটি সংখ্যা প্রকাশ মানে আপসহীন যুদ্ধ জারি রাখার ঘোষণা। সুতরাং এর প্রতিটি পাতা যেন লক্ষ্যভেদী হয়, প্রতিটি রচনা যেন হয় রণক্ষেত্রের বিস্তার-নতুন করে বরং এই চিন্তায় তাঁরা শান দিন। অন্ধকার এই মুহূর্তে গাঢ়তম বলেই তো নিসর্গের-একবিংশের-অমৃতলোকের-কবিতীর্থের নিরবচ্ছিন্ন আলোর ঝলকানি এতখানি প্রয়োজনীয় বিবেচিত হচ্ছে। তবে পরিশীলিত শত্রুরা যখন কৌশলী: ও সংঘবদ্ধ, সে-সময় ছোট পত্রিকার কর্ণধারদের মধ্যে অর্থহীন (ও, কখনো-কখনো, ন্যক্কারজনক) কলহ বন্ধ হোক। ঈর্ষা ও অসূয়া সমবায়ী চেতনার পক্ষে মৃত্যুকীট। বলা বাহুল্য, ওই সমবায়ী চেতনার সমৃদ্ধিতে ছোট পত্রিকার আয়ুষ্কাল নির্ধারিত হয়ে থাকে। পথ আলাদা হোক, ক্ষতি নেই। কেননা এসময় বহুত্বদ্যোতক, বহুস্বর-সঙ্গতি একালের অন্বিষ্ট।

 বরং, তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনাপর্বে দাঁড়িয়ে, লিটল ম্যাগাজিনের যোদ্ধারা আত্মখননকে সমাজখনন ও সময়খননের দ্বিবাচনিকতায় প্রতিষ্ঠিত করার নতুন-নতুন পথ ও পাথেয় খুঁজে নিন। বিষয় নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না, আঙ্গিক নিয়েও নয়। দ্রষ্টা চক্ষু যখন মেলে রাখছি আমরা, অপ্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের প্রতি দায়বদ্ধতা যখন অবিচল রাখছি—বিষয়। ও আঙ্গিক নিজে থেকেই ধরা দেবে। ক্রান্তিকালে পরিধির অবিরাম বিস্তার ঘটিয়ে যাওয়াই কাম্য। যন্ত্রসভ্যতার সাম্প্রতিক উৎকর্ষের পর্যায়ে যেভাবে চিন্তার বিশ্বায়ন ঘটে গেছে, তাতে লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে তৈরি হয়েছে অভূতপূর্ব প্রত্যাহ্বানের পসরা।

১৪৯