পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সোমালিয়ায় ক্ষুৎপীড়িত মানুষের মিছিলে। গত তিন দশকে ঐশ্লামিক মৌলবাদ, হিন্দু মৌলবাদ, নব্য নাৎসিবাদ ইত্যাদির পুনরুত্থানে মুক্ত আলো-হাওয়া-রোদ অনেকটা বিষিয়ে গেছে। এই সময় আত্মপ্রতারণার, পারস্পরিক প্রবঞ্চনারও। ইতিহাস, সামাজিক প্রগতি, মানবিক মূল্যবোেধ ইত্যাদি বিষয়কে মহাআখ্যান বলে যারা প্রত্যাখ্যান করেছে, এরা যে প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন ধাঁচের ও চরিত্রের নয়া উপনিবেশবাদী কৃৎকৌশলগুলিকে আরও পোক্ত করতে চাইছে এবং মানুষকে নির্বাসন দিচ্ছে তারই যত্নে-গড়া জগৎ থেকে—এই অনস্বীকার্য সত্য থেকে আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার আয়োজন এখন সর্বত্র। এই মুহূর্তে যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা।

 আবার এরাই সব ধরনের মৌলিক জিজ্ঞাসা থেকে আমাদের মনোেযোগ সরিয়ে দিতে চায়। এবং এরাই, অগভীর সফরি-সঞ্চরণে অভ্যস্ত থেকে যাবতীয় জিজ্ঞাসু প্রতিবেদনকে তত্ত্বকথা বলে পরিহাস করে আসর জমিয়ে তোলে। এতে অযোগ্যতা ও অক্ষমতা জনিত কিছু অস্বস্তি থেকেও খুব সহজলভ্য পরিত্রাণের পথ এরা পেয়ে যায়। তাদের অগভীরতা, অন্তঃসারশূন্যতা, আঙ্গিক-সর্বস্বতা, সময়-নিরপেক্ষতা আড়ালে চলে যায়। চিন্তা ও মননের সংকীর্ণতা, অনুভূতি ও উপলব্ধির অভাব, ধারাবাহিক অধ্যয়নে অনীহা, বিশ্লেষণে ব্যর্থতা যখন সীমাহীন, তখনই ‘তত্ত্ব’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র এরা আঁৎকে ওঠে। ঘোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় যাদের জীবনের মূলমন্ত্র, এদের জন্যে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হল প্রবাদের সেই অণুগল্পটি:‘কত রবি জুলেরে? কেবা আঁখি মেলেরে!

 মূল প্রশ্নটা হল: তত্ত্ব কী এবং তত্ত্বের কেন প্রয়োজন? এই প্রসঙ্গ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার আলোচিত হয়েছে। তবু আরও একবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।

 ‘তত্ত্ব’ এর আভিধানিক অর্থ হল স্বরূপ বা যাথার্থ। অন্যভাবে বলা যায়, বস্তুস্বরূপই তত্ত্ব। কোনো ঘটনা-বিন্যাস বা ভাব-বিন্যাসের সারাৎসার যখন অনুসন্ধান করি এবং সেই অনুসন্ধানের বার্তা বা প্রতিবেদন তৈরি করি, তখনই তত্ত্বকথা জন্ম হয়। তার মানে, তত্ত্ব হল বিশেষ দৃষ্টি এবং দার্শনিকেরই অন্য নাম তাত্ত্বিক। ইংরেজি ভাষান্তরে তত্ত্বকে বলি “Theory'। এতেও রয়েছে দেখারই প্রসঙ্গ। ল্যাটিন ও গ্রিক উৎসমূলে পাচ্ছি ‘Theoria' যার আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদ (Webster's 3rd New international Dictionary, 1986: 2371 অনুযায়ী) হল ‘act by viewing, contemplation, consideration'। আর, একই উৎসজাত ফরাসি ‘Theorein' এর অর্থও ‘to look at, behold, contemplate, consider'। ওই একই অভিধানে শব্দটির প্রাচীন প্রয়োগ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, Theory হল Imaginative contemplation of reality, Direct intellectual apprehension, insight, অর্থাৎ বাস্তবতার কল্পনা-নিষিক্ত উপলব্ধি বা প্রত্যক্ষ বৌদ্ধিক উপপত্তি বা অন্তদৃষ্টি হল

১৫২