পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অষ্টাবক্র হয়ে যাচ্ছে। সত্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। কায়া হয়ে যাচ্ছে মায়া আর মায়া হয়ে উঠছে কায়িক অস্তিত্ব। দৈনন্দিন জীবনে এবং বিভিন্ন ধরনের সামাজিক সম্পর্কে অতীতের প্রাসঙ্গিকতা থাকছে না কোথাও। সব কিছুতে আমরা পরিবর্তন মেনে নিচ্ছি। বস্তুত স্বতশ্চল ভাবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে যাচ্ছে। অথচ সাহিত্যের পাঠ বিশ্লেষণে আমরা অদ্ভুতভাবে রক্ষণশীল। নতুনভাবে পড়তে, ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে আমরা নারাজ। কেউ যদি নতুনভাবে কথা বলতে চায়, নতুন ওই বাচনকে তত্ত্বকথা বলে উড়িয়ে দিয়ে আমরা ভারি স্বস্তি বোধ করি।‘তাত্ত্বিক বিশ্লেষণটি হয়ে উঠেছে নিন্দাবাচক। বিচিত্র আত্মবিরোধিতার এই প্রদর্শনী সমানে চলেছে।

 সাহিত্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে আরও একটা মজার ব্যাপার দেখা যায়। একদিকে বিশ্বায়নকে মান্যতা দিয়ে আমরা পিটার ইংল্যাণ্ড শার্ট কিম্বা নিউ পোর্ট জিন অথবা রিকার্ডি রামের মতো পানীয়কে আমাদের ঈপ্সিত আধুনিকোত্তর জীবনের চিহ্নায়ক করে নিতে পারি, কিন্তু সাগরপারের কোনো তত্ত্ব-প্রস্থানের ছায়ামাত্র দেখে ব্যাখ্যাতীত শুচিবায়ুর প্রভাবে ‘গেল গেল’বলে আর্তনাদ শুরু করে দিই। পদার্থবিদ্যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ কি বিদেশের বস্তু বলে উপেক্ষিত হতে পারে কখনো? হকিং-এর সময় ও কৃষ্ণবিবর বিষয়ক ভাবনা কি ভারতীয় উপমহাদেশের বৈজ্ঞানিকেরা বিদেশি তত্ত্ব বলে উপেক্ষা করতে পারেন? অথবা ভাষা-বিজ্ঞানে কেউ কি আজ সোস্যুর ও চমস্কিকে এড়িয়ে যেতে পারেন? প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অলীক ব্যবধান বিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৌছাতে পৌছাতে মুছে গেছে। অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স যদি বিভিন্ন ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্য বিভাগে অবশ্যপাঠ্য বলে স্বীকৃত হয়ে থাকে, তাহলে নতুন কালের নতুন দাবি অনুযায়ী ফুকো-দেরিদা-বার্ত-বদ্রিলার-বাখতিন প্রমুখ তাত্ত্বিকদের ভাবনা কেন অনুশীলন করা যাবে না? অ্যারিস্টটল-পরবর্তী পৃথিবী কতবার ওলটপালট হয়ে গেছে; কিন্তু দেশে দেশে সাহিত্য আলোচনায় তার অমোঘ উপস্থিতি তর্কাতীত। তবু এও সত্য যে সার্বিক বিনির্মাণের এ পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে সাহিত্যচিন্তা রুদ্ধ থাকতে পারে না। ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালির সাহিত্য-চিন্তাও নতুন বিশ্বপরিস্থিতির অভিঘাত অস্বীকার করতে পারে না। অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে?

 চিন্তাচেতনায় কোনো ভূগোলের সীমারেখা স্বীকৃত নয়। তা যদি হত, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার রুদ্ধ থাকত তার উৎসভূমিতে। মানুষের পৃথিবীতে যত কিছু নতুন উদ্ভাসন হয়ে চলেছে, তাতে প্রত্যেকের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। যদিও জ্ঞান আর প্রতাপ অন্যোন্য-সম্পৃক্ত এবং তথ্য-উপনিবেশবাদ অত্যন্ত সক্রিয়—মননবিশ্ব এক ও অবিভাজ্য। সেখানে নতুন ধরনের ‘হ্যাভ’ আর ‘হ্যাভনট’-এর বিভাজন মেনে নেবে না কেউ। যেহেতু তাৎপর্য সর্বদা প্রসঙ্গ-নির্ভর, প্রতিটি গ্রহীতা সমাজ নতুন চিন্তা-চেতনাকে নির্বিচারে একইভাবে প্রয়োগ করবে না। নিজের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজন অনুযায়ী যতখানি নেওয়ার নেবে, বাকিটুকু বর্জন করবে। বস্তুত একই তত্ত্ববীজ ভিন্ন ভিন্ন মননভূমিতে আলাদা-আলাদা ফসল উৎপাদন করতে পারে, করে থাকেও।

১৫৫