পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তত্ত্ববীজের উপযোগিতা পরখ করতে গিয়ে চিন্তার অভ্যাসে রৈখিকতা ভেঙে যায়। শেষ পর্যন্ত তার প্রায়োগিক সম্ভাবনা যতটুকু থাক না কেন, বহুদিনের প্রাতিষ্ঠানিক মনন সম্পর্কে তাতে যে-প্রশ্ন দেখা দেয়—এর গুরুত্ব অনেকখানি। বিশেষত সাহিত্যিক পাঠকৃতির বিশ্লেষণে নিরন্তর বিনির্মাণ সবচেয়ে জরুরি। মননের প্রাতিষ্ঠানিক ধরন প্রশ্নের সম্ভাবনাকে শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়। তাই নতুন নতুন জিজ্ঞাসা উসকে দেওয়ার অর্থ যাবতীয় বদ্ধতা-নিষ্ক্রিয়তা-অনীহার জটাজাল থেকে চেতনাগঙ্গার মুক্তি। এই প্রক্রিয়াকে গতিময় করে তোলে নতুন নতুন তত্ত্ববীজের সাহসী ও নিরবচ্ছিন্ন কর্ষণ। অর্থাৎ চিন্তাবীজের ব্যবহার-উপযোগিতা আর ফসলের জমি তৈরির কাজ একই প্রক্রিয়ার এপিঠ আর ওপিঠ।

 বাঙালির চিন্তাবিশ্বে উনিশ শতক যে অভূতপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল, তাতে বহুদিনের রৈখিকতা ও অভ্যাসের গতি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আঠারো শতক পর্যন্ত ব্যাপ্ত সামাজিক ধারাবাহিকতায় বিপুল ছেদ নিয়ে এসেছিল প্রতীচ্যের অজস্র ভাববীজ। সেদিনকার রক্ষণশীল সমাজ যাবতীয় নতুনের বিরুদ্ধে উৎকটভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ইতিহাসের চাকা সব অচলায়তন গুড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে গেছে। অবশ্য, একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লক্ষ করার মতো। নবীন প্রজন্মের যারা নির্বিচারে ও প্রসঙ্গ-বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতীচ্যের ভাববীজকে মান্যতা দিয়েছিলেন—নিজেদের মুদ্রাদোষে ক্রমে তারা আলাদা, কক্ষচ্যুত ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন। অন্যদিকে নবাগত তত্ত্ববীজ ও কর্ষণযোগ্য ভূমির দ্বিবাচনিক সম্পর্ক যাঁরা যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন, তারাই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে সোনালি ফসল ফলিয়েছেন। গ্রহণ ও বর্জনের এই দ্বিরালাপ আসলে সময়েরই আহ্বান। সময়ের কণ্ঠস্বর যাঁরা শুনেও শোনেননি, তারাই বিশ্লেষণশূন্য নিরক্ত মননের কিংবা মননহীনতার পরিচয় দিয়ে অনিবার্যভাবে সময়-বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। ফলে সময়ের মূল স্রোত তাদের নির্মমভাবে পরিত্যাগ করে নতুন ভগীরথদের শঙ্খনাদ শুনে এগিয়ে গেছে।

 বিদেশের ঠাকুর ফেলে স্বদেশের কুকুর উপাসনাকে যতই একমাত্রিক ভাবে শ্লাঘ্য মনে করা হোক না কেন, ইতিহাসের পাতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিন্তু খুব বেশি মর্যাদার অধিকারী নন। বঙ্কিমচন্দ্র গুপ্তকবিকে যতই প্রশংসা করুন না কেন, তিনি নিজে কিন্তু উপন্যাসের মতো সময়-সচেতন ও দ্বিবাচনিক কল্পনায় ঋদ্ধ নতুন প্রকাশ-মাধ্যমটি প্রতীচ্যের ভাবজগৎ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। প্রতীচ্যের তত্ত্ববিশ্ব থেকে আহৃত সাহিত্য-মাধ্যমকে বঙ্কিমচন্দ্র উনিশ শতকের জাগরণ-উন্মুখ বাঙালি চেতনার পক্ষে যথাসাধ্য উপযোগী করে তুলেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তেমনি মহাকাব্যের ভাববীজ ও প্রকরণ সন্ধান করতে গিয়ে ভারতীয় আধার ও প্রতীচ্যের আধেয়ের মধ্যে অপূর্ব দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা সম্ভব করে তুলেছিলেন। Blank verse কোন জাদুমন্ত্রে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রূপান্তরিত হল, তা যদি অনুধাবন করি, তাহলে বুঝব, পয়ারের বেড়ি

১৫৬