পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়। বিশ শতকের গোড়ায় যে সাহিত্যতত্ত্ব প্রাসঙ্গিক ছিল, একুশ শতকের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নতুন সময় নিয়ে এসেছে নতুন প্রয়োজন, নতুন বিনির্মাণ, তত্ত্ব ও প্রয়োগের নতুন বিন্যাস। অবশ্য এইসঙ্গে এও মনে রাখতে হয় যে গ্রহীতার দেশকালজাত যথাপ্রাপ্ত পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্ধারিত হয় কোন তত্ত্ব কতটা স্বীকৃত, বর্জিত, পরিমার্জিত, পুনর্বিন্যস্ত হবে।

 যেমন ধরা যাক প্রতীচ্যের আধুনিকতা বিষয়ক আকল্প ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে, বিশেষভাবে বাঙালির ভাববিশ্বে, অনেকখানি পুনর্বিন্যস্ত হয়েছিল। বিলম্বিত পুঁজিবাদের পর্যায়ে আধুনিকোত্তরবাদের সূচনা হল যখন, বাঙালির চেতনায় তার অভিঘাত বহুধা বিচ্ছুরিত হল। নয়া ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির মধ্যেও এত দ্রুত পটপরিবর্তন হয়ে চলেছে যে গত তিন দশকে উত্তরআধুনিকতা ও আধুনিকোত্তরবাদী চিন্তার সহাবস্থান আমরা লক্ষ করছি। এই বিতর্ক এখনও অমীমাংসিত। প্রবল অনিশ্চয়তা ও কেন্দ্র-বিচ্যুতির আবহে এমন ধরনের আশ্চর্য নতুন সাহিত্যিক পাঠকৃতি রচিত হয়ে চলেছে যে এদের বিশ্লেষণ করতে গেলে পুরোনো পাঠাভ্যাস সংহিতায় আর কুলোচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক তত্ত্বের উপযুক্ত সমর্থন ছাড়া এখন কোনো ধরনের প্রতীতি অসম্ভব।

 মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ঠিক কী কী কারণে পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক উপন্যাসকল্প রচনার ভিড় থেকে আলাদা—প্রথাসিদ্ধ বিশ্লেষণ দিয়ে তার নাগাল পাওয়া অসম্ভব। তেমনি ভোগবাদ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যার অধিগত, কেবলমাত্র তেমন সমালোচকই গত চার দশকের সাহিত্যিক পণ্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও অনান্দনিক চরিত্র যথাযথভাবে অনুধাবন করতে পারেন। আমাদের আধুনিকতার ঔপনিবেশিক চরিত্র যার কাছে স্পষ্ট, তিনিই কেবল বাংলা কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাস-নাটকে অভিব্যক্ত ব্যাধির সংক্রমণ শনাক্ত করতে পারেন। কাকে বলে চিহ্নায়ন প্রকরণ, এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই যাঁর নেই, তিনি কীভাবে কবিতার ভাষায় শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের যুগলবন্দির তাৎপর্য বুঝবেন! জীবনানন্দ-শঙ্খ ঘোষ-শক্তি চট্টোপাধ্যায়-জয় গোস্বামী-রাহুল পুরকায়স্থ-মন্দাক্রান্তা সেনদের চেতনাবিশ্ব কেন পরস্পরভিন্ন, চিহ্নবিজ্ঞানের উদ্ভাসন ছাড়া সম্পূর্ণ অধিগত হওয়া অসম্ভব। আখ্যানের সময় ও পরিসরের দ্বিরালাপ যদি না বুঝি কিংবা ঔপনিবেশিক কাহিনি বয়নের ধরনকে প্রত্যাখ্যান করার তাগিদকে যদি তত্ত্বগত ভাবে বুঝে না নিই, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, দেবেশ রায়, কমলকুমার মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ ভট্টাচার্যদের কথনবিশ্বের স্বাতন্ত্র কখনো উপলব্ধি করব কি? পাঠকৃতির আকরণোত্তর বিন্যাস ও বিনির্মাণের বহুস্বরিক দ্যোতনা সম্পর্কে যিনি উদাসীন কিম্বা পাঠকের সার্বভৌম পরিসর বিষয়ে সাম্প্রতিক চিন্তাধারা থেকে যিনি লক্ষ যোজন দূরে—হাসান আজিজুল হক, রমানাথ রায়, সুবিমল মিশ্র, উদয়ন ঘোষ, কমল চক্রবর্তীদের লেখা পড়া বা না পড়া তার পক্ষে সমান।

১৫৮