পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চল্লিশজন লোক ইত্যাদি উপন্যাসের প্রকৃত স্বাতন্ত্র চিহ্নিত করতে পারি। একইভাবে কবিতা ও ছোটগল্প থেকে আমরা নতুন ধরনের নির্যাস পেয়ে যাই। আরও একটি কথা এখানে বলতে চাই। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, সুবিমল মিশ্র, কমল চক্রবর্তী, অজিত রায়, বারীন ঘোষাল, মলয় রায়চৌধুরীর মতো লিখিয়েরা কেন একই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে উদ্ভুত হয়েও সমান্তরাল সৃজনশীল পরিসরের সূত্রধর এবং কেনই বা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনা-বিশ্বের পক্ষেও তারা প্রত্যেকে নিজস্ব অপরতার সন্ধানী—এই মীমাংসা উপযুক্ত তত্ত্বের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব।

 বস্তুত শুধুমাত্র বাংলা কথাসাহিত্যেই নয়, গত তিন দশকে প্রবন্ধ-সাহিত্যেরও আমূল রূপান্তর ঘটে গেছে। এতদিন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার প্রয়োজনে রচিত ও তথাকথিত সৃষ্টিশীল প্রেরণায় রচিত প্রবন্ধের জলবিভাজন রেখা তৈরি করে অকারণ কটু বিতর্ক চলত। কিন্তু রোলাঁ বার্ত, জাক দেরিদা ও জাঁ বদ্রিলারের কল্যাণে সৃষ্টিশীলতার সংজ্ঞা আমূল বদলে গেছে। প্রাগুক্ত জলবিভাজন রেখা এখন পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক। কেন এই মৌলিক রূপান্তর ঘটে গেছে, এর উত্তর রয়েছে সাম্প্রতিক বিশ্বপরিস্থিতিতে। মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিসর যখন যন্ত্র-প্রযুক্তির দৌলতে খোলনলচে পাল্টে ফেলেছে এবং নতুন নতুন চিহ্নায়ন প্রকরণ তৈরি হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে ও প্রতিটি চিন্তা-প্রস্থানে, সে-সময় প্রবন্ধের প্রতিবেদনও বহুস্বরিক ও বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চায় অভ্যস্তজনেরা অজস্র কুম্ভের ভূমিকা নিয়ে নকল বুদির গড় রক্ষায় ব্যস্ত। তফাত অবশ্য একটু আছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় কুম্ভ কাউকে কটু মন্তব্য করেনি, অকারণ হিংস্রতায় কিংবা অসূয়ায় কাউকে আঘাত করা দূরে থাক, দাঁত খিচানোর কথাও ভাবেনি। কিন্তু যারা প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা বিদ্যাচর্চার দ্বারপাল, সময়ের দাবি অবচেতনে বুঝতে পেরে কিন্তু সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। পায়ের নিচে জমি দ্রুত সরে যাচ্ছে, তা অনুমান করেও দুর্মর অভ্যাসের শেকল ভেঙে তত্ত্ববিশ্বের নতুন সত্যকে স্বীকার করতে পারছে না। তাদের তত্ত্বশূন্য রচনা পুঞ্জপুঞ্জ কথার ফানুস বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে ভেবে এরা সদলবলে ঝাপিয়ে পড়েছে। সব ধরনের তাত্ত্বিক রচনার উপর।

 সময়ের পাঠ গ্রহণে অনিচ্ছুক ওইসব ছদ্মপড়ুয়াদের সংঘ-রচনার জন্যে সাহিত্য থেকে আজ জীবন নির্বাসিত। সাহিত্যের বিশ্লেষণে সমাজতত্ত্ব, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস ইত্যাদির গুরুত্ব এইসব রক্ষণশীল জনেরা মৌখিকভাবে স্বীকার করেন হয়তো, কার্যত কিন্তু বহু প্রজন্ম লালিত চিন্তার অচলায়তন থেকে এঁরা একচুলও সরে আসেন না। রবীন্দ্রনাথের গোরা, রক্তকরবী, কালান্তর এবং এরকম অন্যান্য বই তাদের জন্যে কখনো অনেকার্থদ্যোতক পাঠকৃতি হয়ে ওঠে না। শ্রেণীকক্ষের ভেতরে ও বাইরে প্রতি মুহূর্তে বাংলা বিদ্যাচর্চা নিহত হচ্ছে তাই। আমাদের যে-কোনো সহজিয়া পাঠ তাই ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে নিরালম্ব বায়ুভুক ফানুসের মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও অস্তিত্বতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা জাগিয়ে দিয়ে যেসব তত্ত্বভাবনা

১৬০