পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গভীর তাৎপর্য কতটা সুদূরপ্রসারী, তা তলিয়ে ভাবিনি। অথচ রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, ‘প্রাচীন সাহিত্য, সাহিত্যের পথে’ প্রভৃতি নিবিড় তাত্ত্বিকতায় পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও জীবনজিজ্ঞাসা কীভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে, তা যদি ভালোভাবে লক্ষ করতাম, তাহলে আমাদের রবীন্দ্র-পাঠ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার চক্রব্যুহে রুদ্ধ হয়ে যেত। সব জিনিসকে টুকরো করে আনা আমাদের পদ্ধতি বলে রবীন্দ্রচর্চা আজও অসম্পূর্ণ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে বলে শতবর্ষের ঢাকঢোল সত্ত্বেও জীবনানন্দচর্চাও অসম্পূর্ণ। তেমনি অন্য সব লিখিয়েদের রচনা-পাঠও ছজন অন্ধের হাতি দেখার কথা মনে করিয়ে দেয়। তত্ত্ব-চেতনাকে আমরা কখনো যথাযথ গুরুত্ব দিতে শিখিনি বলে আমাদের যাবতীয় সাহিত্য-পাঠ হয়ে রইল অধমনস্ক, লক্ষ্যশূন্য ও অগভীরতায় আক্রান্ত। তাসের দেশের সেনাদের মতো নিয়মমাফিক পা তুলে পা ফেলে খড়ির গণ্ডির মধ্যে আমরা প্রজন্মের পরে প্রজন্ম ধরে তৃপ্ত থাকতে চাই। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ করলেই শুচিবায়ুগ্রস্ত তর্জনি উদ্যত হয়ে ওঠে। কোথাও বা বিহ্বল কণ্ঠ অভিযোগ করে: ‘আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে!’

 আসলে ভাষা সংযোগ সাধনের মাধ্যম হলেও তাতে যে অধিকারী অনধিকারী ভেদ অবশ্যস্বীকার্য, একথা প্রায়ই ভুলে যাই। সংযোগ হতে পারে শুধু দক্ষ দাতা ও প্রস্তুত বা উপযুক্ত গ্রহীতার মধ্যে। মনে পড়ে ‘বিসর্জন’ নাটকের একটি বিখ্যাত সংলাপ:

 ‘জয়সিংহ: জানো কি একেলা করে বলে?

 অপর্ণা: জানি, যবে বসে আছি ভরা মনে—

  দিতে চাই, নিতে কেহ নাই!’

 যিনি নেবেন, তাকে তো নেওয়ার জন্যে নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। মা-ঠাকুমার কোলে শুয়ে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গল্প শোনা যেতে পারে; কিন্তু বয়স্ক কালের কথাতেও কি একই ধরন সম্ভব? পরিণত বয়ানের জন্যে আবশ্যিক পরিণত মন। মুশকিল এই, অনেক পরিণত শরীরে অপরিণত মন লুকিয়ে থাকে। কারো কারো শৈশব, কৈশোর কিছুতেই কাটতে চায় না। কেউ কেউ আবার জেগে জেগে ঘুমোতে অভ্যস্ত; কোনভাবেই এদের ঘুম ভাঙে না। চারদিকে ঘটনার ঘনঘটা যত আবর্তন তৈরি করুক, দৈশিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি চোখের সামনে যত ওলট পালট হয়ে যাক, ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে যত জটিলতাই দেখা দিক—চোখের ঠুলি অনড় হয়ে এঁটে থাকে। চোখ খুলে দেখাতে চাইলেও এরা দেখতে নারাজ। মান্ধাতার আমলে যেভাবে পড়া, জানা, বোঝা চলত, তেমনি চললেই ভালো, এই হল এদের অভিপ্রায়। যে-ভাষা খবরের কাগজে নিত্যদিন ব্যবহৃত হয়, সাহিত্য বিশ্লেষণেও এঁরা সেই একই ভাষা প্রত্যাশা করেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদিও মোক্ষম কথা লিখে গেছেন—যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্যে কবিকে দোষারোপ করা অন্যায়’—তবু কোনো ইতর-বিশেষ হয়নি। বিনা আয়াসে সব বুঝে নেব, সমস্তই হবে জমা-খরচের হিসেবের মতো প্রাঞ্জল—এই মনোভঙ্গির কোনো বদল নেই। ব্যতিক্রম মাত্রেই উৎপাত হিসেবে নিন্দনীয়।

১৬২