পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আলোচ্য ‘যুগলবন্দি’ গল্পটিও এর প্রমাণ দিচ্ছে। বুরোক্র্যাট সরোয়ার কবিরের কৃপাভিক্ষু আসগর হোসেন এবং কবিরের অ্যালসেশিয়ান আরগসের নামে যে ইচ্ছাকৃত ধ্বনিসাম্য রয়েছে, কার্নিভালের শ্লেষ সেখানেই উতরোল হয়ে ওঠে। বয়ানের শেষে আসগর যখন তার ডান হাতের কজিতে আরগসের শেকলের একটা দিক বেশ টাইট করে জড়িয়ে নেয়, মানুষ ও কুকুরের এমন একাত্মতা ব্যাধিগ্রস্ত বিমানবায়িত সমাজব্যবস্থার অভ্রান্ত প্রমাণ। বিশেষত গল্পকার যখন লেখেন: ‘আসগর সিগ্রেটে বেশ কয়েকটা সুখটান দেয় আর অনুভব করে যে আরগস খুব আরাম ও তৃপ্তির সঙ্গে বাউয়েলস ক্লিয়ার করছে। শিকলের ধাতব বিনুনি বেয়ে সেই তৃপ্তি আসগরের শরীরে চমৎকার মৌতাত ছড়িয়ে দিচ্ছে’—সে-সময় মনে হয় ভাষার অন্তরালে চাবুক উদ্যত হয়ে উঠছে স্থিতাবস্থাপন্থীদের উদ্দেশে। নিঃসন্দেহে শুধু একটা নিটোল গল্প পরিবেশন করাই লক্ষ্য নয় ইলিয়াসের। তিনি পাঠকের মনে বিশেষ কিছু অনুভব সঞ্চারিত করে দিতে চান।

 প্রাগুক্ত ভূমিকায় গল্পকারের বাস্তবতা সন্ধানে ‘স্বকীয় ধাঁচ’-এর কথা বলা হয়েছে। খুব ঠিক কথা। সার্থক ছোটগল্প হতে পারে ওই ধাঁচ বা আকল্পের নিজস্বতায় যা কিনা কাহিনির কাঠামোয়, সংলাপে, বয়নের বিশিষ্ট ধরনে ফুটে ওঠে। তবে সবচেয়ে গুরুত্ব হল অনুপুঙ্খের বিন্যাস কেননা এইসব অনুপুঙ্খ আসলে বাচনের চিহ্নায়ক। ভূমিকাকার মন্তব্য করেছেন: ‘জীবনের অস্থিমজ্জা সারাৎসারের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকতে গিয়ে ইলিয়াস ব্যবহার করেন পর্যাপ্ত ডিটেলস। কেবল বস্তুজগত কি দৃশ্যজগতের সাদামাটা বিবরণ নয়, মানসিক জীবনের সঙ্গে এই জগতের সম্পর্ক এবং মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৃষ্ট তরঙ্গও তিনি খুব গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বর্ণনা করেন ব্যাপক স্থান ও সময় জুড়ে। প্রকৃতি ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কের এই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বিবরণ তাকে সাহায্য করে একটি নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান পেতে এবং সেই অবস্থানে থেকে তিনি স্বচ্ছন্দে সৃষ্টি করেন তাঁর গল্পের জগৎ। ’

 এই মন্তব্যের যথার্থতা ‘যুগলবন্দি’র অনুপুঙ্খ ব্যবহারেও ফুটে উঠেছে। বয়ানের প্রথম অনুচ্ছেদে অনুপুঙ্খ-প্রয়োগের দক্ষতা এমন যে শুধুমাত্র আসগরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎই হয় না আমাদের, তার শ্রেণীগত অবস্থান-ভীরুতা-পরগাছাবৃত্তিও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে উচ্চবিত্ত সরোয়ার বি কবিরের হাস্যকর অন্তঃসারশূন্যতা এবং মুখোসের আড়ালে আসল কাকতাড়ুয়া মূর্তিও গোপন থাকে না। অর্থাৎ ইলিয়াসের সানুপুঙ্খ বয়ান সূক্ষ্মভাবে বহুস্বরিক; এক ঢিলে একাধিক পাখি মারতে পারেন তিনি। ছোটগল্পের প্রারম্ভিক অনুচ্ছেদ হিসেবে এই অন্তর্নাট্য ঋদ্ধ অংশটি অনবদ্য এবং লক্ষ্যভেদী। তা সরাসরি পাঠককে প্রতিবেদনের মর্মস্থলে নিয়ে যায়:

 ‘আসগর।’

 কার্পেটে বসে আসগর হোসেন তখন খালি সব বোতল থেকে ফোঁটা ফোঁটা তলানি ঢালছিল নিজের জিভে। মস্ত ড্রয়িং রুমের আরেক মাথায় সরোয়ার বি কবিরের হুইস্কিশোষা গলা গমগম করে উঠলে প্রথমে সাড়া দেয় বারান্দায় বসে থাকা

১৬৭