পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আশায় যে তার খেদমত প্রভুকে সন্তুষ্ট করবে। কিন ‘সায়েবের ফেভারিট কাজগুলো যখন করে সায়েব তখন লক্ষই করে না’, এ জাতীয় বিবৃতিতে উতরোল হয়ে ওঠে শেষ। বয়ানে ইংরেজি শব্দের প্রয়োগও গল্পকারের সূক্ষ্ম বোধের প্রমাণ: যেমন ‘ফেভারিট’। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা কিংবা ভাবা আসলে নিজেকে সম্রান্ত করে তোলার অবচেতন প্রয়াসেরই অভিব্যক্তি। কখনো-কখনো অবশ্য তাতে মিশে যায় তীব্র শ্লেষ ও স্যাটায়ার। আর, যৌন অনুষঙ্গের সূক্ষ্ম ব্যবহারে পারদর্শী ইলিয়াস বাচনের এই বিভঙ্গকে প্রসারিত করে যান ক্রমাগত। দৃষ্টান্ত হিসেবে নিচে যে-অংশটি উদ্ধৃত করছি, তা অন্তর্বয়নের জন্যেই আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে। সাহিত্যের সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্য আর ব্রিলিয়াণ্ট অ্যাকাদেমিক ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলে যে সরোয়ার কবির, সে কোনো ব্যক্তি নয়, সে তার শ্রেণীর প্রতিনিধি। গল্পকারের কঠিন ব্যঙ্গ ওই শ্রেণীবদ্ধ মানুষের কাকতাড়ুয়া মূর্তি ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে।

 ‘আসগর আড়চোখে সার্ভে করে; না, চেহারা দেখে তার মুড বোঝবার জো নাই। তবে মিসেস জেসমিন বি কবিরের মেজাজ বোধহয় ফর্মে নাই, বেডরুমে লোকটা সুবিধা করতে পারেনি। আহা, এতোবড় জাঁদরেল অফিসার—যার হাত দিয়ে লক্ষপতি কোটিপতিদের রোজগারের খানিকটা চালান হয়ে আসে রাষ্ট্রীয় তহবিলে—দ্যাখো বৌয়ের মেজাজের জন্য মাসে কম করে হলেও ৪/৫ দিন তাকে কাটাতে হয় ড্রয়িং রুমে, স্রেফ সোফায় কি ডিভানে আধশোয়া অবস্থায়।

 এক পলকে মনে পড়ে যায় হাসান আজিজুল হকের অনবদ্য ছোটগল্প ‘পাব্লিক সার্ভেণ্ট’ এর কথা। যুগলবন্দি’র সঙ্গে তার তফাত অনেক; তবু কোথাও যেন আত্মিক সাদৃশ্য রয়েছে। সরোয়ার কবিরেরাই শেষপর্যন্ত মামুন রশীদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। একই গোত্রের মানুষ এরা; দুজন দু-পর্যায়ের। রাষ্ট্রযন্ত্র এদের দৌলতেই টিকে থাকে; কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতাপের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হয়ে পার্থিব সম্পদে ফুলে-ফেঁপে উঠতে গিয়ে এরা যে নিজেদের মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপ করে তুলছে, তার আভাস পাই জেসমিনের কাছে সরোয়ারের খানিকটা জব্দ হওয়াতে। আর, এর উৎকট পরিণতি লক্ষ করি মামুন রশীদের চোখের সামনে তার স্ত্রী শায়েলার ধর্ষণে। হাসান দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের তাবেদার হয়েও রাষ্ট্রশক্তিরই ভাড়াটে গুণ্ডাদের দ্বারা নিজের স্ত্রীকে ধর্ষিত হতে দেখে আমলা মামুন। আসলে এ হল ছোটগল্পের নিজস্ব চিহ্নায়ক খচিত বাচন। গাদাগাদা অপরাধের তলায়...থ্যাতা ইদুরের মতো গাজলা তুলে’ মরে যারা, মামুন এবং সরোয়ার তাদেরই প্রতিনিধি। ধর্ষণের সাতদিন পরে শায়েলা নীরবতা ভেঙে স্বামীকে ধিক্কার দেয় এভাবে: ‘তোমার নিজের সম্মানও তোমার কাছে এতটুকু নেই। একটা কেম্নো বা একটা গিরগিটির সঙ্গেও তোমার তুলনা চলে না। সেটা সারা দেশের কেউ না জানলেও আমি জানি। ছ্যাকড়া গাড়ির গাড়োয়ান হয়ে চাবুক হাকড়াচ্ছো... তোমার মত চামচিকে বেঁচে থাকে কবে যে মরবে? একেই সম্ভবত ‘Poetic

১৬৯