পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

justice’ বলে। অর্থাৎ এই ধিক্কার কেবল শায়েলার নয়, সংবেদনশীল সব পাঠকের এবং স্বয়ং গল্পকারেরও। অন্তত এখানে পাঠক ও লেখকের পরিসরের মধ্যে কোননা দ্বন্দ্ব নেই। আগেই লিখেছি, হাসানের ‘পাব্লিক সার্ভেণ্ট’ হল সম্ভাব্য সমাপ্তিবিন্দু; আর, ইলিয়াসের যুগলবন্দি’কে বলতে পারি সূচনাবিন্দু। সরোয়ার কবিরেরা অমোঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অবধারিত ভাবে মামুন রশীদের পরিণতিতে পৌছে যায়।

 এই নিরিখে দেখলে বুঝতে পারি কীভাবে ‘যুগলবন্দি’তে উপস্থাপিত পৌর সমাজের একফালি ছবির পেছনে রয়ে গেছে রাজনৈতিক সমাজেরই অলক্ষ্যগোচর অথচ দুরপনেয় ছায়া। আমাদের এখানে মনে পড়ে যায় স্বয়ং ইলিয়াসের অসাধারণ একটি প্রবন্ধের কথা। বাংলা ছোট গল্প কি মরে যাচ্ছে?’ নামক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, তথাকথিত ছোট সুখ ও ঘোট দুঃখের পেছনে রয়ে যায় সমাজ ও সময়ের অনেক বড় উপকূলরেখা। এইজন্যে ছোট সুখ বা ছোট দুঃখ বলে কিছু হয় না। যেমন এই ‘যুগলবন্দি’ গল্পেও আসগর ও আরগসের নামগত সাদৃশ্য পুঁজিবাদের বিমানবায়ন প্রক্রিয়ার চিহ্নায়ক। আসগর সর্বহারা নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত বর্গে তার অবস্থান। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সেও একটি বল্ট কিংবা পেরেক। চরম বিকারগ্রস্ত মনস্তত্ত্ব নিয়ে সে কেবল সুযোগের সন্ধান করে বেড়ায়। সরোয়ার কবিরের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ইলিয়াস কার্নিভালের আবহ তৈরি করেছেন: ‘আসগর হোসেন কি?—না, তার বোনের চাচাতো না মামাতো দেওরের বন্ধু। এটা কোন সম্পর্ক হল? আসলে তো চাকরির উমেদার?” যেহেতু আসগর স্বপ্ন দেখে যে সারোয়ারের সাহায্যে সে ম্যাকডোনাল্ড অ্যাণ্ড রবিনসন্স-এ চাকরি পাবে এবং চাকরি হলে ফার্নিশড ফ্ল্যাটে আধুনিক তরুণীকে বিয়ে করে রাত কাটাবে—বড়লোকের উমেদারি করতে গিয়ে সে নির্দ্বিধায় নিজেকে ভৃত্যের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। সে বি.এ. পাশ করেছে, তার পরিবারে মা, বাবা, ভাইবোন আছে। রিটায়ার্ড পোস্ট মাস্টারের ছেলে হিসেবে নিজের শ্রেণীগত অবস্থানে সে মোটেই খুশি নয়। তার কাছে নৈতিকতা বা দায়িত্ববোধের কোনো গুরুত্ব নেই। আমেরিকান জাহাজের এক নাবিককে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে পটাতে পেরেছিল বলে বন্দর থেকে একটা ফ্রিজ সরিয়ে নিয়েছিল। যে সমাজ-ব্যবস্থায় ফ্রিজ থাকাটা সামাজিক চিহ্নায়কে পরিণত, সোজাপথে সেই স্তরে পৌছাতে পারে না। আসগর।

 অতএব সম্পর্কিত ভাই সিকান্দারকে সরোয়ার সাহেব চাকরি দেওয়ার পরে আসগর তার স্থলাভিষিক্ত হয়। শুধু সরোয়ার নয়, তার স্ত্রী জেসমিনের মনোরঞ্জন করার জন্যে সে সর্বদা শশব্যস্ত। রাত পৌনে একটায়ও তাকে কমলালেবু খুঁজে আনার জন্যে বেরিয়ে পড়তে হয়। এ ধরনের কাজ করতে সে যে অভ্যস্ত, গল্পকার তা আমাদের জানিয়েছেন নানা ভাবে। বিনিময়ে সায়েবের একটু আধটু অর্থ আত্মসাৎ, সিগারেটের প্যাকেট থেকে কয়েকটা সরিয়ে নেওয়া: এসব সে করে খুব তৎপরতার সঙ্গে। যেহেতু রৈখিক বৃত্তান্ত তুলে ধরা কাম্য নয় ইলিয়াসের, তিনি শ্লেষের বারুদ পুরে দিয়েছেন প্রতিবেদনে। সংবেদনশীল পাঠক ওই বারুদে অগ্নিসংযোগ করবেন কিনা, সে

১৭০