পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বার করার সময় এ্যালসেশিয়ানটা গরর গরর করলে আসগর ডাকে, আরগস। দূর। ডাকটা হার্শ হয়ে গেল। সরোয়ার কবির শুনে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে মোলায়েম ও আদুরে করে বলে, আরগস’। এবার গলাটা বেশি নিচু হয়ে গিয়েছিল। সরোয়ার কবির শুনলো তো?’ শেষের বাক্যটি যেন শ্লেষের চাবুক হয়ে আমাদের মানবিকতা বিষয়ক গর্বের উপর আছড়ে পড়ে।

 ইলিয়াস যে কত বড়ো নির্মাণশিল্পী ছিলেন, এর প্রমাণ রয়েছে ঠিক তার অব্যবহিত পরবর্তী অনুচ্ছেদে। এখানে তিনি সচেতন ভাবেই প্রতিবেদনের রৈখিকতা ভেঙে দিয়েছেন। নইলে ছোটগল্পের আখ্যানে হয়তো বা গল্প বলছি, শোনো জাতীয় আদল ফুটে উঠত। কেউ কেউ অবশ্য বলতেও পারেন, লেখকস্বর এখানে গল্পের বাস্তবতাকে খানিকটা আড়াল করে দিয়েছে। এতক্ষণ যে আসগরকে দেখেছি, তাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য এক অপরিচিত ও ঈষৎ পরাবাস্তব অস্তিত্ব পাদপ্রদীপের সবটুকু আলো শুষে নিচ্ছে। তাহলে গল্পকার কি বোঝাতে চান আমাদের, যে, এধরনের সম্ভাব্য অপরসত্তা প্রচ্ছন্ন থাকে প্রতিটি রুদ্ধাবকাশ অস্তিত্বের মধ্যে? গল্পত্ব এখানেই যখন বাস্তবের আঁটোসাঁটো গাঁথুনি এমনি আচমকা বিনির্মিত হয়ে যায়। হয়তো এ হেন অপরতার উদ্ভাসন দীর্ঘস্থায়ী হয় না; আলো ক্ষণিকের জন্যে জ্বলে ওঠে কেবল অন্ধকারকে গাঢ়তর করার জন্যেই। ঢাকার রাজপথে নিশুতি রাতে বেরিয়ে আসগর নিজেরই অজ্ঞাত সেই অপরসত্তার মুখোমুখি হচ্ছে অথচ তার গভীর তাৎপর্য সে নিজে বুঝতে পারছে না। আর, পারছে না বলেই লেখকস্বরকেই মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে বয়ানে। এই দৃষ্টিকোন থেকে এবার লক্ষ করতে পারি আসগরের বিরল অনুভূতির বিবরণকে: ‘এরকম অদ্ভুত লাগেনি কোনোদিন কোথাও পাতলা কোথাও ঘন কুয়াশার আড়ালে পাহাড়গুলো ভারি রহস্যময়। পাহাড়ের এখানে ওখানে আলো জ্বলে, কুয়াশায় সেইসব আলো এখন ঝাপসা। কখনো ১টি আলো ২টি ৩টি আলোয় ভাগ হয়ে লুকোচুরি খেলে। গাড়ির হেডলাইটের আলো কুয়াশা ছিড়তে ছিড়তে নিজেই গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, ফ্যাকাসে অন্ধকার বড়ো অপরিচিত মনে হয়। গাড়ির জানলা খোলা, সেদিক দিয়ে পাহাড়ের ঠাণ্ডা নিশ্বাস এসে মুখে লাগে। জানলাটি উঠিয়ে দিতে বাধো বাধো ঠেকে, মনে হয় কেউ অসন্তুষ্ট হতে পারে। পাহাড়ের গায়ে গাছগুলো সরে সরে যাচ্ছিলো, হঠাৎ করে চোখে পড়ে একটু দূরে পাহাড়ের মাথায় ন্যাড়া ঢ্যাঙা গাছের পাতা ঝরা ডালে ডিমে তা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে রয়েছে কৃষ্ণপক্ষের কালচে রক্তের রঙের চাদ। ডাল ভেঙে শালার চাঁদ পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়লে মহা কেলেঙ্কারি!

 সন্দেহ নেই যে বাচনে লেগেছে পরাবাচনের আভা কেননা এই বিন্যাসের মর্মমূলে। রয়েছে পরাবাস্তবের দ্যুতি। এই বিশিষ্ট বাঙ্গির পরিণত রূপ আমরা দেখেছি ‘খোয়াবনামা’র অসামান্য ঔপন্যাসিক সন্দর্ভে। একে বলা যেতে পারে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার অভিব্যক্তি যা কিনা পলকে রুদ্ধ নিরেট বাস্তব পরিসরের মধ্যেও গোপন

১৭২