পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
গ্রহাণুপুঞ্জের আকাশ

এপাশে মায়ের মৃতদেহ, ও পাশে বাবার মৃতদেহ
মাঝখানে সে, মাত্র দু-বছর হল সে পৃথিবীতে এসেছে।
তার মাকে ফুল দিয়ে গেছে
বাবাকেও ফুলে ফুলে ঢেকে দিয়ে গেছে
পৃথিবীতে এত ফুল আছে?
আমরা বড়োরা জানি কখন আমরা ফুল দিই,
জ্বালাই কখন মোমবাতি?

 এবছর ফেব্রুয়ারিতে এই কবিতাটি পড়েছি। অন্তর্জাল আর ই-মেল শাসিত দুনিয়ায় আমরা যতই মহানাগরিক সপ্রতিভ আর চতুর নির্মাণের ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হই না কেন, কবিতার ভাষাকে দুমড়ে মুচড়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার চালাকি দেখতে না-পেয়ে আশ্বস্ত হই যেন। একুশ শতকের এই প্রারম্ভিক দশক যখন ধীরে ধীরে অন্তিম প্রহরে পৌছে যাচ্ছে, এখনও কত অনায়াসে ফুল ও মোমবাতি চিহ্নায়িত বাচনের ভিত্তি হতে পারে। চারদিককার ধূসর ও নিরাবেগ অভ্যাসের ফুর্তি-ফার্তার মধ্যে এখনও চাপা অন্তর্নাট্যের আভাস বিষাদের স্নান আভা বয়ে আনে কবিতায়। মা ও বাবার মৃতদেহের মাঝখানে দু-বছরের একটি বিপন্ন শিশুর উপস্থিতি তো আশ্চর্যজনকভাবে আজকের সময়েরই শিল্পিত উপস্থাপনা। তবু শিল্পের নির্মাণকলাও সমকালের নিষ্ঠুর সত্যকে আড়াল করতে পারে না। কবিও কি তা-ই চেয়েছেন? আসলে এ হল উচ্চারণের সামাজিকতা যা সর্বদা কবির সময়-নিষ্পন্ন অনুভূতির অভিব্যক্তি।

 সাম্প্রতিক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি পড়ুয়াদের কাছে অবিমিশ্রভাবে প্রতিভাত হয় কি? যতদিন যাচ্ছে, ভঙ্গুর পৃথিবীর তুমুল অনিশ্চয়তা ও ভরকেন্দ্রহীন ভাবনা কিংবা ভাবনাহীনতার আবর্তে শ্বাসরুদ্ধ হতে হতে খুঁজে পাওয়া কঠিন, কোথায় আমাদের উপনিবেশোত্তর অবস্থানের বহুমাত্রিক স্বীকৃতি আর কোথায়-ই বা আধুনিকোত্তর সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের এলাকা! এ বড় বিচিত্র ঘূর্ণিপাকের সময় যখন সাপ ও নেউল স্বচ্ছন্দে সহাবস্থান করে। শিবির বদল হয় মুহূমুহূ, নন্দন ও প্রতিনন্দনের মধ্যে লক্ষ্মণরেখা লুপ্ত হয়ে যায়। যে-সপ্রতিভ মানুষটি সময়-সচেতনতার পতাকা বয়ে নিয়ে যাওয়ার দুর্নিবার তাড়নায় অন্তর্জাল-সাইবার কাফে-মোবাইল-শপিংমলের ঝাঁ-চকচকে দুনিয়ায় স্বেচ্ছাবন্দি হয়ে পড়েছে, তার কাছে কবিতা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-নন্দন সহ মূদ্রাস্ফীতি সেনসেক্স-খুচরো দেশপ্রেম তালিবানীকরণ—আর ডি এক্স: সমস্তই তো একই রকম বার্তাহীনতার খবর হয়েই আসে। অর্থাৎ আদৌ আসে না। ব্রেকিং নিউজ

১৭৭