পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সংস্কৃতি সহ যাবতীয় মানবিক কৃতির প্রকরণ ও অন্তর্বস্ত, নিষ্কর্য ও অন্বিষ্ট কি কেবল ঘাতক সময়ের হনন প্রস্তুতিকেই লক্ষ করবে? না কি বহুমাত্রিক সময়ের বর্ণচ্ছটা কিংবা বর্ণহীনতার তাৎপর্যকে ধারণ করার উপযোগী নতুন কৃৎকৌশল তৈরি করে নেবে? মানুষ-সভ্যতা-ভাবাদর্শ-ইতিহাসের অপমৃত্যুর একমাত্রিক ব্যাখ্যায় তৃপ্ত থেকে শুধু মেনে নেওয়া ও মানিয়ে নেওয়ার চালাকি ও প্রসাধন রপ্ত করে নেবে? নাকি নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক না হয়ে সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে আপন পরিসর ও অবস্থানকে যথাযথভাবে শনাক্ত করে নেবে যাতে বিপন্ন শিশুর চোখেও খুঁজে নেওয়া যায় যিশুর চোখের মতো চোখ?

 মনে দ্বিধা ও জিজ্ঞাসা জাগে তবু। সর্বজনীন সত্য বা সর্বসঞ্চারী উপলব্ধি বলে কিছু আছে কি আদৌ! বিশ্বায়নের পর্যায়ে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কি আধিপত্যবাদী শশাষণ-চাতুর্য ও চিত্তবৃত্তির উপনিবেশীকরণ সংক্রান্ত যুক্তিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হতে পারে কখনও? সেইসঙ্গে আরও একটি জরুরি জিজ্ঞাসা জাগে। যথাপ্রাপ্ত অবস্থান যেহেতু অনস্বীকার্য এবং আলাদা আলাদা ভাবে ও যৌথভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিকরাজনৈতিক ভূগোলের বিপুল বাধ্যবাধকতা অনতিক্রম্য—সুনির্দিষ্ট অবস্থানগত বাস্তবতা তো প্রাগুক্ত জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রবণতাগুলির পরিগ্রহণকেও নিয়ন্ত্রণ করে। যে-বাংলা ভাষায় এই প্রতিবেদনটি লিখছি, ইতিহাসের নানা পর্বে সেই ভাষা-ব্যবহারকারীদের মননমুদ্রাও বহুবাচনিক হয়ে পড়েছে। কলকাতা মহানগরের শিকড়বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের মুদ্রাদোষে নিজেরা যেভাবে আলাদা হয়ে গেছেন, বিস্তীর্ণ মফস্সলের বাসিন্দা লিখিয়ে ও পড়ুয়াদের সঙ্গে তারা কি ভুলেও কখনও আত্মীয়তা অনুভব করেন? প্রশাসনিক সূত্রে কিংবা সরকারি ব্যবস্থাপনায় এই দুইপক্ষকে নিয়মিতভাবে একই আঙিনায় জড়ো করা হয়। কিন্তু এঁদের মধ্যে পাউরুটির ঐক্যও তো দেখা যায় না। একপক্ষে যদি থাকে ঔদ্ধত্য ও তাচ্ছিল্য তো অন্যপক্ষে থাকে বিচিত্র হীনমন্যতা বা অসূয়াজনিত বিকার। বাংলার ভাষামহল এখন অজস্র পরস্পর-বিরুদ্ধ তাবুর সমাবেশমাত্র। একই ভাষাজননীর সন্তানেরা কেউ কেউ সুয়োরানী ও কেউ কেউ দুয়োরানীর পুত্র কন্যা হয়ে পড়েছেন। স্বভাবত এঁদের প্রত্যেকের সত্য এবং সময় ও পরিসরের মিথস্ক্রিয়ার প্রতীতি পরস্পর দ্বিমেরুবিষম।

 বাংলা নামে দেশের পরিস্থিতিও ঐতিহাসিক কারণে অনিবার্যভাবে জটিল যা আলোচনার জন্যে স্বতন্ত্র প্রবন্ধের পরিসর প্রয়োজন। একই বাংলা ভাষার সন্ততি হয়েও দেশভাগ নামক আদিপাপ কী পশ্চিমবঙ্গে কী পূর্ববঙ্গে সামূহিক স্মৃতিলোপের ফলে মনোভূমি থেকে হারিয়ে গেছে। চর্যাপদেরও আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল যে অখণ্ড বাঙালি বিশ্ববীক্ষার অবিভাজ্য অভিব্যক্তির—১৯৪৭-কে দানবায়িত করে আমরা সেই যাত্রার তাৎপর্য ভুলে গেছি। যে-জাতি মেকি আন্তর্জাতিকতার প্রতি একদেশদর্শী মুগ্ধতায় কৃত্রিম ভঙ্গির অনুকরণে সর্বস্ব পণ করে বসে—সেই জাতির অপমৃত্যু নিশ্চিত। তার ওপর রয়েছে উদ্ভট সংকরসত্তা তৈরির আয়োজন: কোথাও মধ্যপ্রাচ্য আর কোথাও আর্যাবর্ত তার হোতা। ফলে পরম্পরাগত ভাবে নানা পর্যায়ে প্রতিবেশী

১৭৯