পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি ধর্মচর্যা-বিশ্ববীক্ষা থেকে নানা ধরনের উপাদান আত্তীকৃত করতে করতে বঙ্গজেরা যে সংশ্লেষণী মননমুদ্রা রপ্ত করে নিয়েছিলেন, আত্মঘাতী মূঢ়তায় সেইসব বিস্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। প্রাক-আধুনিক পর্ব পর্যন্ত অজস্র দ্বন্দ্ব-সংঘাত গোষ্ঠীজীবনে নিশ্চিতভাবে এসেছিল; কিন্তু সেইসব আর যা-ই হোক পায়ের নিচের জমি আর মাথার উপরের আকাশ মুছে দেয়নি। কিন্তু গত শতাব্দীতে যা ঘটল, তাতে বিশ্বায়ন দ্বারা আক্রান্ত বাংলা ভাষা-ব্যবহারকারীদের মধ্যে ময়ূরপুচ্ছধারী কাক হয়ে ওঠার উৎকট আকাক্ষা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল। নয়া ঔপনিবেশিক প্রভুত্ববাদের কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হয়ে যে মগজ-ধোলাইয়ের আয়োজনকে কার্নিভালের উৎসব-মত্ততায় রূপান্তরিত করা হল, তাতে উৎপাদিত হল শুধু মেধার সন্ত্রাস। ফলে হারিয়ে গেল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, মুছে গেল যাবতীয় অভিজ্ঞান উৎকেন্দ্রিকতার অতিব্যক্ত উপস্থাপনায়। মেকি আন্তর্জাতিকতার অজস্র শিবির গড়ে উঠল মহানগর সহ আধাশহরগুলিতে।

 একে আমাদের নিজস্ব আধুনিকোত্তর পরিস্থিতি বলা যাবে কী না, তা নিয়ে কিছু সংশয় আছে। তবে এটা ঠিক, এই শ্বাসরোধী পরিবেশের মোকাবিলা করতে চান কোনও কোনও কবি-লিখিয়ে। কেউবা হয়তো আরোপিত কুহককে অকাট্য সত্য বলে ধরে নিয়ে তারই আদলে নিজেকে তৈরি করে নেন। সময়ের চিহ্ন আন্তরিকভাবে যাঁরা খুঁজতে চান, তাঁদের প্রতিবেদনে যুগপৎ ফুটে ওঠে শ্লেষ ও বিষাদ, ক্রোধ ও লাস্য। ভাবা যেতে পারে, বাচনের বিশিষ্ট ধরনেই ফুটে ওঠে তাদের প্রতিবাদ ও যন্ত্রণা। এ-প্রসঙ্গে সব্যসাচী ভৌমিকের ‘কালবেলা' কবিতাটিকে তাৎপর্যবহ বলে মনে হয়।

‘অবাক কান্না মিহি কুয়াশায় জড়ানো
নাগরিক মন ছিটকে পড়ছে যন্ত্রে
যন্ত্র মানব একলা এবং সদলে
গণ বাঁধকেই মেঘ হারানোর মন্ত্রে
মন্ত্র সাধন কিংবা শরীর পাতন
শরীরে মিশছে ফেরারী পতিত বিশ্ব
তৃতীয় বিশ্ব শপিং মলের স্বপ্নে
ভাঙা হাঁড়ি কুড়ি বিলিয়ে বিলিয়ে নিঃস্ব

যতবার খুঁজি আগুনের বারমাস্যা
মাটি খুঁড়ে ওঠে একঘটি জল ভিক্ষার
আমরা সবাই কাগজে কলমে ব্যাঘ্র,
আগুন ভুলেছি দশকের ছায়াছত্রে।’

 সময়ের স্বর ও অন্তঃস্বর এভাবেই কবিতার ভাষার গ্রন্থনাকে পাল্টে দেয়। সন্দেহ। নেই যে সময়-চিহ্নিত ছোটগল্প এবং উপন্যাসের ভাষাও একইভাবে পুঞ্জীভূত অভ্যাসের

১৮০