পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থেকে ভাবনা-বিশ্বের নিয়ন্তা তত্ত্বে যদি পৌছানো না যায়, সমস্ত চেষ্টাই হবে পণ্ডশ্রম মাত্র। একদিকে পরস্পর বিবাদমান ও বেপথুমান জাতিগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে সম্ভাব্য অন্বয়ের জন্যে নিরুৎসুক ভাবনা ও উদাসীন অনাগ্রহের টানাপোড়েন এবং অন্যদিকে কল্পিত কোনও সাহিত্যকেন্দ্র বা সংস্কৃতিকেন্দ্রের প্রতি কখনও সচেতন কখনও অবচেতন আনুগত্য: এইসব কিছুর সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ায় বিশেষভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষীদের পরস্পর-বিচ্ছিন্ন সাহিত্য-প্রয়াস যেন নেপচুন নামক গ্রহের মতো সৌরমণ্ডলের আলোককেন্দ্রকে পরিক্রমা করে চলেছে। সম্ভবত লেখা উচিত ছিল গ্রহাণুপুঞ্জের মতো। তবু এও অনস্বীকার্য যে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বাংলা ভাষাভাষীদের আত্মতৃপ্ত উদাসীন স্বয়ংলালিত সৌরমণ্ডলে পরস্পরের সঙ্গে যত অনতিক্রম্য ব্যবধানই রচিত হয়ে থাকুক, আত্ম-বিস্মরণ সত্ত্বেও অভিন্ন চেতনার পরম্পরায় প্রত্যেকে লালিত। তা-ই উত্তর-পূর্বাঞ্চল যতই বহুজাতি-উপজাতির সমাবেশ হোক না কেন, Ethnicity সংক্রান্ত গুরুগম্ভীর বিদ্যায়তনিক গবেষণার আঁধি ও ধোঁয়াশা সত্ত্বেও অন্তত সৃজনশীল নন্দনের নিজস্ব বিধি-বিন্যাসকে তা মুছে ফেলতে পারেনি।


 কেন এখানকার সাহিত্যচর্চায় জীবনানন্দ বা বিভূতিভূষণ, নিদেনপক্ষে ওয়ালীউল্লাহ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়-ভাস্কর চক্রবর্তী-সুবোধ সরকার-খোন্দকার আশরাফ হোসেন আবির্ভূত হলেন না, এ সম্পর্কে আক্ষেপের কোনও মানে হয় না। এখানকার শক্তিপদ ব্রহ্মচারী বা অন্য কেউ কেন শঙ্খ ঘোষ বা উৎপল কুমার বসুর মতো লিখবেন, কেনই বা মিথিলেশ ভট্টাচার্য বা দেবব্রত দেব লিখবেন দেবেশ রায় বা ভগীরথ মিশ্র বা হাসান আজিজুল হকের মতো? একটু আগে স্বতন্ত্র আলো হাওয়া রোদের সঞ্জীবনী উপস্থিতির কথা লিখেছি, তা তো কেবল কথার কথা মাত্র নয়। আমাদের না থাকুক মরুভূমির আকাশে তারা, না-ই বা সপ্রতিভ ভঙ্গিতে লিখলাম আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে।’—আমাদের আছে একান্ত নিজস্ব পা রাখবার ভূমি, আছে অনন্ত ভাসানে যাওয়ার আয়োজন, আছে নিজস্ব কক্ষপথ ও টুকরো টুকরো গাথা-প্রত্নকথা-কিংবদন্তি এবং আছে সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে স্বখাত-সলিল কথা রচনা।

 উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নগরায়ন এসেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিংবা এসেছিল তবুও আসে নাই জানায়ে গেছে। কিন্তু এখানেই তো হয়েছে—অভূতপূর্ব ভাষা আন্দোলন; বারবার মাতৃভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছে তরুণ তরুণীরা। আর্যাবর্ত ও মধ্যপ্রাচ্যের নিরবচ্ছিন্ন নেতিবাচক ও পশ্চাত্মখী উপস্থিতি এবং নয়া ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী আগ্রাসন সত্ত্বেও ভাষা-চেতনা এখানে এখনও পান্থপাদপের শুশ্রষা এনে দেয়। তাই প্রকট আত্মবিরোধিতা ও আত্মঘাতী তৎপরতা সত্ত্বেও গ্রহাণুপুঞ্জের আকাশ জুড়ে নিজস্ব আলোর প্রাসঙ্গিকতা অম্লান রয়ে গেছে। নইলে অন্তহীন প্রতিকূলতার মধ্যে (যার মধ্যে রয়েছে প্রকাশন সংস্থার অনুপস্থিতিও) নিজেকেই ইন্ধন করে কীভাবে জ্বলে ওঠেন উত্তর-পূর্বের কবি-লিখিয়েরা! এক দশকের আগেই সংঘ ভেঙে যায় এখানে, তবুও নতুন করে শিকড়ে আলোর সন্ধান শুরু হয়। কল্পিত কোনও চিন্তাকেন্দ্র বা প্রধান শিবিরের আশ্রয় নেবার জন্যে নয়, অখণ্ড বাঙালি মননের

১৮৬