পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পড়বে, আনুপাতিক হারে মধ্যবয়স্কদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এর পরে রয়েছে যারা এখন আর তত তরুণ নয়। সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ টগবগে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা সবচেয়ে কম। অথচ ঠিক উল্টো ছবিটা দেখার কথা ছিল। সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক বাস্তব বিস্তীর্ণ চোরাবালির মতো অপেক্ষমান।

 কেন এমন হল? তথ্য ও বিনোদনের মাদক আমাদের দৈনন্দিনকে আচ্ছন্ন করছে। যখন, সাফল্য-শিকারীরা ভোগবাদী সমাজের মাপে নিজেদের খোলনলচে পাল্টে ফেলছে। প্রতিটি ঘরে ঘরে চলছে আত্মপ্রতারণা ও আত্মসম্মোহনের নির্বিবেক প্রক্রিয়া। সর্বব্যাপ্ত সম্মোহনকে বাস্তব বলে ধরে নিচ্ছে প্রায় প্রত্যেকেই। কালবেলার উপযোগী এই মোহিনী আড়াল। পণ্যায়নের প্রভাব ষাটের দশক থেকেই সাহিত্যে ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক পণ্য সাহিত্যের পুরোহিতেরা মার্কিনী কায়দায় যৌনতা ও হিংসার অনান্দনিক মিশ্রণ ঘটিয়ে ‘বেস্ট সেলার’ উৎপাদনে সচেষ্ট ছিলেন। পরে ক্রমশ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপবিশ্বাস, মৌলবাদী প্রবণতা, অলৌকিকতা ইত্যাদি। একদিকে উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপযোগী মানসিকতা আমদানি করে অন্যদিকে চরম রক্ষণশীল প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বিচিত্র পাঁচন তৈরি হচ্ছিল। নব্বই-এর দশক থেকে উন্নত প্রযুক্তির উপযোগী আধুনিকোত্তরবাদের ছায়া এসে যুক্ত হল। ফলে আমাদের সাহিত্যের বিজ্ঞাপনধন্য জনপ্রিয় ধারাটি স্তরে স্তরে সাহিত্যের নামে ভ্রমকথারই তাণ্ডব চালিয়ে গেছে। পাশাপাশি অবশ্য ছোট পত্রিকায় সাহিত্যের বিকল্প ধরন ও বিকল্প চেতনা সন্ধানের প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক পর্যায়ে যে অভূতপূর্ব সর্বাত্মক আক্রমণ সাংস্কৃতিক নয়া উপনিবেশবাদীরা শুরু করেছে, অভিঘাতের ব্যাপকতায় তার সঙ্গে কিছুই তুলনীয় নয়।

 এর আগেও মানুষের ইতিহাসে বহু দুর্যোগ এসেছে, মননে ও সাহিত্যে নানা ধরনের অনন্বয় তৈরি হয়েছে। অন্তর্বস্তু ও প্রকরণের মধ্যে উপযুক্ত রদবদল ঘটিয়ে মানুষকে দুর্যোগ বরং ঋদ্ধ করেছে আরো। কিন্তু অতি সম্প্রতি মানুষ যেভাবে নিজেরই তৈরি যন্ত্র-প্রযুক্তির কাছে দাসখৎ লিখে দিয়ে নিজেকে নিজেই অবান্তর করে তুলছে—এরকম আগে কখনো দেখা যায়নি। মানুষ এখন আত্মহননের মাদকে মশগুল। দুরন্ত গতি ও উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়ের নেশায়, সম্পদ থেকে আরো সম্পদ তৈরির অন্ধ প্রতিযোগিতায় স্বয়ং সময় অলীক হয়ে পড়ছে। এখন কোথাও কোনো পৌবাপর্য নেই, প্রেক্ষিত নেই, প্রাসঙ্গিকতাও নেই। অর্জনীয় কোনো সত্য নেই, আছে কেবল নিত্য নতুন সত্য-ভ্রম উৎপাদনের প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক এই পর্যায়কে বলা হচ্ছে self ignition, self seduction এর পর্যায়।

 তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনাপর্বে এতদিনকার অর্জন-ব্যর্থতা-সম্ভাবনাকে নিশ্চয় যুক্তিনিষ্ঠভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা এখানেই যে আমাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভেতরে এবং চিন্তা-অনুভূতি-উপলব্ধির মধ্যেও রয়েছে অজস্র কূটাভাস, শূন্যায়তন ও গোলকধাঁধা। এইজন্যে সন্দর্ভ তৈরি করতে-না-করতে আমরা মাঝপথে সেসব ভেঙে দিচ্ছি। আসলে ভেঙে যাচ্ছি নিজেরাই। প্রত্যয় নিয়ে কোনো কিছুকেই

১৬