পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিশ্বসুন্দরী হিসেবে ঘোষণা করার মধ্যে ব্যক্ত হয়। কারণ সর্বাত্মক মুক্তিকামী নারীচেতনাকে পথভ্রষ্ট করার জন্যে এবং পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দৃঢ় প্রোথিত করার জন্যে তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসীদের উপর নতুন বিউটি মিথ চাপিয়ে দেওয়া আবশ্যিক। একটু আগে যাকে বিষাক্ত ছত্রাক বলেছি, তার বিপুল সংক্রমণ বুঝতে পারি যখন আসামের বরাক উপত্যকার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনুষ্ঠিত হয় সুন্দরী প্রতিযোগিতা। সমানুপাতিক হারে হুহু করে বেড়ে যায় বিলিতি মদের কেনাবেচা ও যৌন সন্ত্রাস।

 ওই একই আকল্পের সূত্রে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে চরম আদিখ্যেতা করা হয়। সবই পণ্যায়নের স্বার্থে। সাহিত্যের নতুন বিধি-বিন্যাস তৈরি হতে থাকে তারই অদৃশ্য প্রেরণায়। নইলে অরুন্ধতী রায় থেকে ঝুম্পা লাহিড়ী রাতারাতি বেস্ট সেলার হয়ে যেতেন না। এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি। একদিকে কম্পিউটার প্রযুক্তির মায়ায় ভিস্যুয়ালের সন্ত্রাস ব্রহ্মাণ্ডগ্রাসী এবং পাঠাভ্যাস ভ্রান্ত পথে মরীচিকা-প্রত্যাশী, অন্যদিকে সাহিত্যসংবিদ ঢাকী সুদ্ধ বিসর্জনে যাওয়ার পক্ষে। মাঝখানে ত্রিশঙ্কুর মতো দোদুল্যমান আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধি-যুক্তি-সংস্কার-বিবেক। অধিবাস্তব জগতে আরম্ভ নেই, বিকশিত হওয়া বা করাও নেই। এই অধিবাস্তবতায় ‘more and more areas of social life are reproductions of models organized into a system of models and codes' (তদেব)। আসলে তো চিহ্নায়কও নেই, সামাজিকতাও নেই এখন। আছে কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন মুহূর্তের অবভাস। বদ্রিলার স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘Today it is quotidian reality in its entirety-political, social, historical and economic that from now on incorporates the simulatory dimension of hyperrealism' (Simulations: 147).

 এই কালবেলায় প্রতিদিনকার জীবন যখন ক্রমশ বেশি করে অধিবাস্তব হয়ে উঠেছে, সাহিত্যের সমস্ত প্রতিবেদনকেই তৈরি হতে হচ্ছে যুদ্ধের জন্যে। আক্ষরিক এবং রূপক দুই অর্থেই জীবন মূলত যুদ্ধক্ষেত্র। পাঠকৃতিও তাই। কোনো-এক মুহূর্তের চিহ্নায়কের আগ্রাসনে পূর্ববর্তী মুহূর্তের চিহ্নায়ক লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যেমন, তেমনি সেও তো আগামী সমস্ত অস্থির চিহ্নায়কের পক্ষে ভবিষ্যৎ অতীত মাত্র। চূড়ান্ত অস্থির ও অনিশ্চিত এই পরিসরে সত্যভ্রম ও প্রতিবাচনের কাছে কি হার মানবেন ছোট পত্রিকার যোদ্ধারা? সমস্ত পুরনো আকল্প নস্যাৎ করে কালবেলা যদি ভ্রমকথার বুদ্বুদমালা উপস্থাপিত করে, তাও তো এক আকল্পই। সমস্ত ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও সাহিত্যকে দাঁড়াতে দেখি জটিল জিজ্ঞাসায়, আত্মমন্থনে। সবাই নিশ্চয় চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেন না। হয়তো বা কেউ কেউ আবার আবর্তই তৈরি করেন কেবল আর নিজেদের অগোচরে নব্য স্থিতাবস্থার সমর্থক হয়ে ওঠেন। তবু লিখন-প্রক্রিয়ার বিনির্মাণ অব্যাহত থাকে। সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রশ্ন বড়ো নয়। রবিশঙ্কর বল, মধুময় পাল, স্বপন সেন যখন তাদের বয়ানে প্রতিসন্দর্ভকেও গ্রথিত

২২