পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 কিন্তু পুঞ্জ-পুঞ্জ ছাইয়ের মধ্যে কোথাও কি নেই এতটুকু আগুনের ইশারা? প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাস আরো বিকৃত, আরো আরো জরাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কি আশ্চর্য থাকবে না কোথাও? আধুনিকোত্তর প্রতিজীবনের উদ্ধত মহড়া সত্ত্বেও সত্যের দ্বিবাচনিক উপস্থিতি তো অনস্বীকার্য। সকল কাঁটা ধন্য করে ফুল ফুটবে নয়, ফুল ফুটছে। আছে, আছে, আশ্চর্য আছে, সংস্কৃতির কুসুম আছে। বিশ্বপুঁজিবাদ, বিশ্বমৌলবাদ, মরিয়াও-না-মরতে-থাকা সামন্তবাদের গাঁটছড়া সত্ত্বেও নিবাত নিষ্কম্প দীপশিখার মতো নিঃসঙ্গ, পবিত্র, জেদি, অধ্যবসায়ী আগুন জ্বলছে। জেগে থাকার, জাগিয়ে রাখার আগুন। তা যদি না হত, শতচ্ছিন্ন বাঙালির ছন্নছাড়া ভুবনে নিশ্চয় ছোট পত্রিকার সমিধ আহরণ অব্যাহত থাকত না। আনখশির বিদূষণের উন্মত্ততা সত্ত্বেও পণ্যসর্বস্বতা-ভোগবাদ-কপটতা-অসূয়ার চক্রব্যুহ পেরিয়ে গিয়ে প্রতিস্রোত তৈরির দৃষ্টান্ত দেখা যেত না। পুরুলিয়া-বালুরঘাট-মেদিনীপুর- ধানবাদ- আগরতলাগৌহাটি-শিলচর-বগুড়া-সিলেট-চট্টগ্রাম-রাজশাহ-বরিশাল-গাইবান্ধার মতো জনপদে বেরোত না প্রতিস্রোতপন্থী ছোট কাগজ। স্বাতন্ত্রেই তাদের অভিজ্ঞান, তাদের নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধ। কেননা লিটল ম্যাগাজিনের সেনানীদের চেয়ে বেশি কে জানে আর, সমস্ত তাৎপর্যই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জনীয়! লেখা মানে যুদ্ধ, পত্রিকা মানে যুদ্ধক্ষেত্র; এই যুদ্ধে সিসিফাসের মতো অধ্যবসায় আছে শুধু, কেবলই পাথর চুড়োয় তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া নতুনভাবে শুরু করে যাওয়া। একটি সংখ্যার প্রকাশ মানে পরবর্তী সংখ্যার জন্য যুদ্ধাস্ত্রে শান দিতে শুরু করা, কেবলই এক লক্ষ্য থেকে অন্য লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাওয়া। এই যাওয়ার নাম জীবনানুশীলন, যার আরেক নাম সংস্কৃতি।

 এইজন্যে শিলচরে প্রতিস্রোতের তরুণেরা এখানে মুঠোয় মশাল ধরে রেখেছেন। অতন্দ্র অনিশ শতাব্দী স্বপ্নিল উদর্ক শতক্রতু ইত্যাদির অগ্ন্যাধান ব্যর্থ হয়নি। অন্ধকার যখন গাঢ়তম, বরাক উপত্যকার বাঙালিরা প্রতিস্রোত ও সাহিত্যের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন জেগে থাকার প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতিপূর্ণ চিহ্নায়ক। পরিসররিক্ত অবস্থানেও উত্তর পূর্বের বাঙালিরা একা এবং কয়েকজন’, ‘পূর্বদেশ গল্পপত্র’, ‘পাহাড়িয়া’, ‘মুখাবয়ব’-এর মতো সময়সেনানীর যুদ্ধ-বার্তা ঘোষণা করতে পারেন। মহানাগরিক কলকাতায় এবং ঢাকায় পান্থপাদপ খোঁজার প্রয়োজন নেই এখন। আমাদের নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দিয়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁদের দিকে তাকিয়ে জীবন ও পাঠকৃতির ভ্রান্ত পাঠ থেকে আমরা নিয়ত জায়মান মুক্তপাঠে যাওয়ার সংকেত বুঝে নিতে পারছি। সমীরণ মজুমদার (অমৃতলোক), আফিফ ফুয়াদ (দিবারাত্রির কাব্য), এজাজ ইউসুফী (লিরিক), মোস্তাক আহমেদ দীন (বিকাশ), ফারুক সিদ্দিকী (বিপ্রতীপ), সরকার আশরাফ (নিসর্গ), অমিত দাস (উত্তরাধিকার), সুবল সামন্ত (এবং মুশায়েরা), অঞ্জন সেন (গাঙ্গেয়পত্র), উৎপল। ভট্টাচার্য (কবিতীর্থ), পাঠকৃতি (শুভেন্দু ইমাম) এবং এরকম আরো অনেক যোদ্ধা শৌর্য ও লাবণ্যের যুগলবন্দি অক্ষুন্ন রাখছেন। কত ভিন্নতা তাদের অবস্থানে। আধুনিকোত্তর কালবেলায় দাঁড়িয়ে তাদের সামূহিক উপস্থিতি আর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াণ-পটভূমিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বুঝতে পারি।

২৬