পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আক্রমণ এবং স্বদেশকে রক্ষা করতে সমর্থ হয়েও চক্রান্তের শিকার কমলার আত্মবিসর্জন: এই হল মোদ্দা বিষয়। কিন্তু এহ বাহ্য। বগুড়ার প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে বগুড়া থিয়েটারের এই অসামান্য নাট্যপাঠকৃতির রচনা এবং হিন্দুমুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির সাধারণ ঐতিহ্যভাণ্ডারে উত্তরাধিকার সন্ধান—এই বিষয়টি এ সময়ের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ক। নাটক অভিনীত হওয়ার পরে সতেরো বছরের তরুণী থেকে পঁচাত্তর বছরের প্রবীণ অভিনেতার জ্বলন্ত উৎসাহ দেখেশুনে মানুষের ওপর এবং সংস্কৃতি নামক প্রাণভ্রমরের ওপর অস্খলিত বিশ্বাস যেন ফিরে পেয়েছি নতুন করে।

 ‘কথা পুণ্ড্রবর্ধন’-এর নাট্যকার তৌফিক হাসান ময়না গ্রন্থনাতে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছেন। কারণ সংস্কৃত ও পালি মন্ত্র এবং হিন্দুধর্মের আচার অনুষঙ্গ সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার মতো উৎসুক জন খুব বেশি নেই ওই অঞ্চলে। পরিচালক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ নাটকের আগে এবং পরে জানালেন, সাধারণত সংস্কৃতি এবং বিশেষভাবে নাট্যসংস্কৃতির স্বার্থে তিনি বাঙালির উৎস-সন্ধানে যাত্রা করেছেন। পুণ্ড্র অঞ্চল মনসামঙ্গল কাব্যেরও পৃষ্ঠভূমি। অতএব তার পরবর্তী নাট্যবীজ আহরণের জন্যে তিনি বাঙালির ওই ঐতিহ্যভূমিকে খনন করবেন। শুনি আর অভিভূত হই। ভাবি, বরাক উপত্যকার কুয়োবাসী বাঙালি আমরা, নিজেদের আগে হিন্দু মনে করি কিংবা মুসলমান। বগুড়া থিয়েটার ২৯ মে ১৯৮০ থেকে নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দেওয়ার যে অসামান্য সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, “রি সামাজিক তাৎপর্য মৌলবাদ-লাঞ্ছিত পরিসরে সবচেয়ে বেশি প্রকট। বগুড়ার বার্তা বরাকে নিয়ে যাওয়া যায় না? মনে পড়ে গেল উত্তরবঙ্গে বাগডোগরায় আরো একজনকে জানতাম। তিনি পেশায় চিকিৎসক, নেশায় নাট্যকার ও পরিচালক, ডাক্তার দেবপ্রসাদ কর। নিভন্ত চুল্লিতে আগুন যোগান দিয়ে যাচ্ছেন তিনিও। শশাষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এবং অন্যদের দেখান। খাঁটি বাঙালি না হলে যে খাঁটি মানুষ হওয়া যায় না, এই জেনে তিনি বাঙালির হারানো পৃথিবী খুঁজে যাচ্ছেন দুর্মর জেদে ও বিপুল তিতিক্ষায়। লিখতে পারি শিলচরের ছন্দোময় তরুণ জয়ের (যার পোশাকি নাম সৌমিত্রশঙ্কর চৌধুরী) কিংবা গানে-গানে ভুবন পরিক্রমায় মগ্ন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের কথা। জয়ের নাচ আর শুভর গান যে ঘুম-ভাঙানিয়া সোনার কাঠি। তাই ওরা দুঃসহ আঁধারে জেগে থাকা ও জাগিয়ে রাখার ব্রত নিয়েছে। লিখতে পারি নাটকের শিল্প, সংবেদনাকে জীবনের মুখরিত সখ্যে নিয়ে-আসা শেখর দেবরায় ও বিশ্বজিৎ দাসের কথাও যারা বিদূষণের হিংস্র তাণ্ডবের মধ্যে নীল আকাশ আর নির্মল সুপবনের কথকতা করে। শৈশবের অমল ধবল পাল উড়ছে তাই শিলচরে, ফিরে এসেছে বিশ্বাস: আছে আছে জীবন আছে উত্তাপ আছে। সৌন্দর্য আছে। জয়-শুভ-বিশ্বজিৎ-শেখরের অস্তিত্বে মিশে যায় তৌফিক-দেবপ্রসাদের অবয়ব। আর সিলেটের শুভেন্দু ইমাম-লীনেন-বাবু-বান্না-দীনদের আস্তিত্বিক মূর্ছনা। জীবনের সংস্কৃতিই তো বাঙালির সংস্কৃতি: এই বার্তা উঠে আসে তাদের সমবায়ী উপস্থিতি থেকে।

২৯