পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এইজন্যে ‘বগুড়া থিয়েটারের কথা’ নামক ছোট্ট প্রতিবেদন পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, আধুনিকোত্তর পিশাচ-সময়ে তিন ভুবনের বাঙালিরা তো যাত্রী একই তরণীর। ওরা আর আমরা—এই বিভাজন কে করে? এই বার্তা কি নয় প্রত্যেকের: ‘আমাদের জনগোষ্ঠীর মন মানসিকতায় যখন সামত্ত সংস্কৃতির অবশেষসমূহ শিকড় গেড়ে বসে আছে, যে মুহূর্তে সমাজের কর্ণধারেরা পুরনো বস্তাপচা প্রতিক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে লালন করে চলেছে, পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক জোয়ারে যখন দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে ঠিক সে মুহূর্তে শোষণ নিপীড়নই যে শেষ কথা নয়, যুগ যুগান্তরে সঞ্চিত বিক্ষোভের ঘনীভূত পরিণতিতে নতুন দিন আসছে, আসবেই, মানুষের মনের জমিতে নাটকের মাধ্যমে এ বিশ্বাসের শিকড় গাড়তে এবং দেশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সবার মাঝে তুলে ধরার মানসে তাদের আত্মপ্রকাশ। এবং সবার, সমস্ত সংস্কৃতিযোদ্ধার!

 অতএব ইতিহাস-সংস্কৃতি-সভ্যতা-ব্রহ্মাণ্ড নয়, অভ্যাসের অবসাদ পুড়ছে। আগ্রাসী লোভ পুড়ছে ইন্ধনসহ। মানুষ নয়, মানুষের ছদ্মবেশ পুড়ছে। পুড়ুক। নিভন্ত এ চুল্লিতে সই আগুন ফলেছে।

 অদ্ভুত আঁধার নেমেছে বাঙালির ভুবন জুড়ে। শুধু যে অন্ধজনেরা সবচেয়ে বেশি দেখার ভান করছে এখন, তা-ই নয়। আত্মঘাতের মাদক ব্যবহারের কত রকম বিধি রপ্ত করছে বাঙালি। একুশ শতকের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভাবছি, উদীয়মান এ-শতকে আমাদের সামূহিক সত্তার সমস্ত অভিজ্ঞানই ধূসর স্মৃতির মহাফেজখানায় মূঢ় অবহেলায় জমা দিয়ে এলাম নাকি? বিশ শতকের গোড়ায় জোর ঝটকা লেগেছিল বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে। তখন না হয় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন! বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার মন এক হোক, এই ইচ্ছে জানিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। আর ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, অকালপ্রয়াত হওয়ার আগে তিনি বাঙালির জন্যে স্বরাজের নতুন তাৎপর্য বয়ে এনেছিলেন। জাতীয় মনন ও স্বপ্ন জাগানোর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে নিঃশব্দ চরণে পেরিয়েও গিয়েছিল! জীবনানন্দ ওই মুহূর্তের স্বপ্নসম্ভব পাঠসংহতি তৈরি করেছিলেন রূপসী বাংলার কবিতাসন্দর্ভে। ছিলেন নতুন পথের দিশারি ঘুম-ভাঙানিয়া নেতাজী সুভাষ। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির ভূখণ্ড নয় কেবল তার ঐতিহ্য সংস্কৃতি, তার স্মৃতি ও বিবেক পর্যন্ত বিভাজিত হয়েছিল। উপনিবেশগ্রস্ত মন দিয়ে রাজনৈতিক ঠিকাদারেরা দ্বিজাতিতত্ত্বের ঢোল-শহরৎ করেছিলেন তখন। অসহায় সাধারণ মানুষ, ক্লাইভের আমলের মতোই, জেগে ঘুমোচ্ছিল। সবাই বলেছিলেন পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবাংলার মধ্যে বাঙালি সত্তার দ্বিধাবিভাজনের কথা। কেউ ভেবে দেখেননি, এ আসলে ত্রিধা কিংবা বহুধা বিভাজন। দেখেননি, প্রান্তিকায়িত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরা আরও ব্রাত্য হয়ে গেলেন। এবং, স্বাধীনতার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্যের অনন্বয় দিনানুদিন তীব্রতর হল কিনা সংকীর্ণ আঞ্চলিক চেতনার আগ্রাসনে—এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না কোথাও। উগ্র আঞ্চলিক

৩০