পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আধিপত্যবাদের অনিবার্য পরিণামে বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছিল বাঙালির ভাষিক স্বাতন্ত্র মুছে ফেলার চেষ্টা। বারবার তাই ছিন্নমূল হতে হয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিকে। দেশবিভাজনের ফলে কয়েক পুরুষের বাড়ি-জমি তো শুধু ছাড়তে হয়নি, তারা উৎখাত হয়েছিলেন বিশ্বাস-সংস্কৃতি-মানবিক সম্পর্কের প্রত্যয় থেকেও। এর বিষক্রিয়া কত দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এর প্রমাণ অহরহ পাচ্ছি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাঙালিদের মধ্যে মৌলবাদী ভাবনার প্রাধান্যে। যাঁদের কোনোদিন ভিটেমাটি ছাড়তে হয়নি, তারা কোনোদিন বুঝবেন না কেন এইসব ছিন্নমূল মানুষের চেতনায় ইতিহাস নিছক খলনায়কদের তৈরি জঞ্জালের স্থূপ মাত্র। এরা জীবন ধারণের তাগিদে ছড়িয়ে পড়েছিলেন ত্রিপুরায়, আসামে, মেঘালয়ে। প্রতিকূল পরিবেশে লড়াই করতে করতে সবেমাত্র যখন পা রাখবার এক চিলতে জমি খুঁজে পাচ্ছেন—ঠিক তখনই তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদীরা। আর, সর্বস্ব খুইয়ে নতুনভাবে উদ্বাস্তু হচ্ছেন তাঁরা।

 বহির্ভারতের অন্যান্য অংশ তো দূর অস্ত, পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা এসব খবর কি রেখেছেন কখনো? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে খোলাখুলি লিখছি, ত্রিপুরায় বাঙালি আছে—এটা জানলেও আসাম মেঘালয় সম্পর্কে অনেক বিচিত্র সব ধারণা নিয়ে রয়েছেন তারা। আসামে বাঙালির সংখ্যা কতটা এবং বরাক উপত্যকা যে মূলত বঙ্গীয় সংস্কৃতির শেষ আউটপোস্ট—এ বিষয়ে এঁরা কিছুই জানেন না এবং জানতে চান না। বহু উপভাষায় বিন্যস্ত বাংলা ভাষা সম্পর্কে, বলা ভালো, উপভাষা-অঞ্চল সম্পর্কে কৌতুক ও তাচ্ছিল্য আছে—এইমাত্র। সবাই সুকুমার সেন বা সুনীতি চাটুজ্যে পড়ে মাতৃভাষার সমৃদ্ধি বিষয়ে অবহিত হবেন, এতটা আশা করি না। কিন্তু অস্তেবাসী বাঙালিরা কিছুমাত্র ‘কম’ বাঙালি নন তাদের তুলনায়, এইটুকু অন্তত জানবেন তো! বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে এবং বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করার বিচিত্র সংগ্রামে ক্ষতবিক্ষত হয়েও যাঁরা লড়াই করছেন, তাদের জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। আমরা ইহুদিদের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করি, কিন্তু বাঙালির তৃতীয় ভুবনে অহরহ কী ঘটছে, সে বিষয়ে অণুমাত্র আগ্রহ দেখাই না। বরাক উপত্যকায়, মেঘালয়ে তো বটেই, আসামের অন্যান্য অঞ্চলে, নাগাল্যাণ্ডে, মণিপুরে বাঙালিদের ধোপানাপিত যে কবেই বন্ধ হয়ে গেছে—সে-খবর রাখি কেউ? আমরা জানি, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলা ভাষার জন্যে শহিদ হয়েছিল বরকত-সালাম-জব্বারেরা। কিন্তু, এখনও আমরা অনেকে জানি না ১৯৬১ সালের ১৯মে শিলচর শহরে (দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকার সদর শহর) একটি তরুণী সহ ১১টি তরুণ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইতে শহিদ হয়েছিল। শিলচর রেলস্টেশনে নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর আসাম পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছিল। দশ ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন প্রাণ দিয়েছিল কেননা বাংলা ভাষায় কথা বলত। ওরা। স্বাধীন ভারতবর্ষে এমন ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে কি?

 ১৯৬১ সালে থেমে যায়নি রক্তস্রোত। ১৯৭২ সালে আরও একজন আর ১৯৮৬ সালে দুজন শহিদ হয়েছে। বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা, কিন্তু খিড়কি দুয়ার

৩১