পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ছোটো মাপ তৈরি করে নেওয়া হচ্ছে। কূপমণ্ডুকতার সর্বগ্রাসী ছায়া সঞ্চারিত হচ্ছে সমস্ত কাজে লেখায় চিন্তায়, আন্তঃসম্পর্কের বয়ানে।

 যখন ভাবি প্রথম ভুবনের কথা, দেখি যে, বাঙালিত্ব ও ভারতীয়ত্বের ভুল দ্বন্দ্ব সম্পর্কে প্রবল ঔদাসীন্য অন্য-এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা তৈরি করেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এমন-এক নব্য মুষলপর্বের লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠছে ক্রমশ, যার অভিঘাতে ভণ্ডামি, কৃত্রিমতা, অন্তঃসারশূন্যতা তৈরি করে চলেছে কেবল থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। লোক-দেখানো আনুষ্ঠানিকতা আর প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসের বাইরে মনন ও সৃষ্টি যেতেই চায় না। একুশ শতকের ভেতরে পৌছাতে চাইছে বাঙালি নিছক প্রবাহ রক্ষার আয়োজন দিয়ে। কিছুদিন আগেও যা-কিছু ছিল বাঙালির ক্ষুরধার মেধা ও প্রতিস্রোতপন্থী মননের সূতিকাগার, সেইসব এখন দ্রুত শুচিতা হারিয়েছে। যে-কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনে বা গবেষণাকেন্দ্রে ইদানীং চোখে পড়ে কেবল অসূয়া, নির্লজ্জতা, প্রভু-ভজনা ও ফাপা আত্মম্ভরিতার চলমান প্রদর্শনী। জীবনানন্দের ভাষা অনুসরণ করে লিখতে পারি, যারা অন্ধ, সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা। তাই শেয়ালের ও শকুনের খাদ্য এখন মেধা ও স্বপ্ন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। যেভাবে আবহমানের ভাড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে, তাতে মনে হয়, অবক্ষয়ী আধুনিকতা ও বিশ্বায়নলব্ধ আধুনিকোত্তরবাদী সম্ভোগ-মাদকের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণই বাঙালির সময়-মুদ্রা এবং এই মুদ্রাগীতির মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে তৃতীয় ভুবনেও। প্রান্তিকায়িত বাঙালির জন্যে উপাংশুকথনেও ক্ষয়ের বিলাসিতা, এই তার অস্তিত্বের অভিজ্ঞান। একুশে ফেব্রুয়ারির কৃষ্ণচূড়া যাদের চেতনার রঙে রঞ্জিত হয়ে বাংলা নামে দেশের জন্ম দিয়েছিল, দ্বিতীয় ভুবনের সেই বাঙালিদের জন্যে ইদানীং বিশ্বায়ন এসেছে এন জি ওর মোহনবেশে। পোশাক পাল্টে পাকিস্তানি অপচেতনা দ্রুত ঢুকে পড়েছে সদর থেকে অন্দরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো সক্রিয় বলে তালিবানি সন্ত্রাস সত্ত্বেও সাহিত্য-সংস্কৃতির মননবিশ্ব আবিল হয়নি। কিন্তু সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা দিনদিন নানাভাবে স্পষ্টতর হচ্ছে। একদিকে মৌলবাদের ক্ষিপ্ত অসহিষ্ণুতা, অন্যদিকেউপভাষাকেন্দ্রিক ভয়ংকর আঞ্চলিকতা। এদের পথ ভিন্ন, লক্ষ্য এক, যেন-তেন প্রকারেণ বাঙালিত্বকে ভেতর থেকে ভাঙো! ঐশ্লামিক পরিচিতিকে উসকে দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্বগত ন্যায়বৃত্তকে চূর্ণ করতে চায় মৌলবাদীরা। আর উপভাষা-স্বাতন্ত্রবাদীরা চায় বাঙালিকে আরও টুকরো করে দিতে। সম্প্রতি হাতে এল লণ্ডনে প্রকাশিত একটি বই, সিলেটি ভাষা’ও ওই ‘ভাষাগোষ্ঠীর পরিচিতি বিষয়ে। বিভাষাকে ভাষা বলে চালানোর মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই—এই বলে উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু যাচ্ছে না। কারণ, বিশেষভাবে এই উপমহাদেশে এবং সাধারণভাবে বিশ্বের বহু স্থানে আঞ্চলিক পরিচিতিকে উসকে দিয়ে বিভাজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার প্রক্রিয়াটি খুব চেনা। হতে পারে, এটা মগ্নশৈলের চূড়ামাত্র। এরপর যদি চট্টগ্রামে এজাতীয় কিছু ব্যাপার শুরু হয়ে যায় (যেমন হয়েছে পশ্চিমবাংলায় তথাকথিত কামতাপুরি নিয়ে), একে তো হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা, এর

৩৪