পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নৈরাজ্যের রৌরব ঘনীভূত হতে থাকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে। বস্তুত হতে থাকে নয়, হয়ে গেছে। বিশ্বায়নের দোসর চূড়ান্ত বিমানবায়নের গ্রহণ লেগেছে ভারতের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও, বাপে তাড়ানো মায়ে-খেদানো আমাদের বরাক উপত্যকায়।

 যেহেতু এই এলাকা চিরকালই পাণ্ডব-বর্জিত, এখানকার আকাশে-বাতাসে পুষ্ট হয় কেবল হীনমন্যতা। আলো-হাওয়া-রোদ কোথায় যেন কোন অদৃশ্য ও অমোঘ প্রতিবন্ধকে ঠিকরে যায়। ঝাপসা কাচের আড়ালে সব দৃশ্যই দৃশ্যের কুহক হয়ে ওঠে, সব বার্তাই সত্যভ্রমের বার্তা। নইলে চরম কূপমণ্ডুকতার ও যুক্তিহীনতার অবারিত সমাবেশ এখানকার জনমানসে মৌলবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রতিক ভেদবুদ্ধিকে তৃতীয় সহস্রাব্দের সূচনা-পর্বেও এতখানি অবারিত করে তুলত না। গত কুড়ি বছরে ধাপে ধাপে যাঁদের অবনমন সম্পূর্ণ হয়েছে, সেই শিক্ষক সমাজ তাই আজ আর চেতনার প্রহরী নন। তাদের আর কোনো অর্থেই বুদ্ধিজীবী বলা চলে না। ব্যবসা-সর্বস্ব মনোবত্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বলেই কোনো ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাদের টিকিটিও দেখা যায় না। অথচ ১৯৬১, ১৯৭২ ও ১৯৮৬-এর ভাষা আন্দোলন সহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তাঁদের অনেকেই ছিলেন অগ্রণীর ভূমিকায়।

 মোটামুটি ভাবে গত তিন দশকে কেন এই অন্ধকারের অন্ধলিপি তৈরি হল, তা আজ তলিয়ে ভেবে দেখার সময় এসেছে। অসুখের বহুমাত্রিক অভিব্যক্তির সঙ্গে লড়াই করার বদলে কেন গোটা সমাজ ভেসে গেল বৈনাশিক অপচেতনায়—এর পেছনে কি গভীর আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রভুত্ববাদীদের যৌথ চক্রান্ত রয়েছে? আজ ধ্বস্ত হয়ে গেছে ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষাদান-বিধি। বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির মধ্যে চূড়ান্ত বিচ্ছেদ এনে দিয়ে বিজ্ঞান-শিক্ষাকেও কতকগুলি পূর্বনির্ধারিত প্রকল্পের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন নতুন পাঠ্য-বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বহু গুণ বেড়ে গেলেও কম্পিউটার ও ইণ্টারনেটের প্রকৃত তাৎপর্য চিন্তা-চেতনার মধ্যে শুষে নিয়ে শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাপ্রকরণকে যথাযথভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার কোনো গভীর আয়োজন নেই।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়, এখনই প্রকৃত সময় ফিরে দেখার ও পুনর্গঠনের। এতক্ষণ যে-প্রেক্ষিতের কথা লিখেছি, তা অনস্বীকার্য নির্মম বাস্তব। সময়ের সঙ্গে সুর-তাল মেলানো মানে আত্মবিস্মৃত হয়ে স্রোতে ভেসে যাওয়া নয়। কিন্তু অভ্যাসের ধারাবাহিকতাকেও ভেঙে দিতে হয় কখনো কখনো। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, আমাদের নিজেদের মধ্যেই এমন কোনো মারাত্মক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা যার ফলে বালির ঝড় এড়ানোর জন্যে আমরা উটপাখির মতো মাটিতে মুখ গুঁজে দিয়েছি। সময়ের প্রহার থেকে নিছক আত্মরক্ষা করার চিন্তায় আমরা

৩৯