পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কেবল অন্ধকার সুড়ঙ্গেই ঢুকে যেতে পারি। অতএব সংশয় ও কুয়াশা পেরিয়ে নিজেদের জন্যে আলোর শুশ্রুষা নির্মাণ করাই বেশি জরুরি।

 মাধ্যমিক স্তরের সবচেয়ে নিচু ধাপ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উঁচু ধাপ পর্যন্ত শিক্ষকতার চল্লিশ বছর ব্যাপী অভিজ্ঞতায় কিছু কিছু ভেতরের সমস্যা বোধহয় বুঝতে পেরেছি। তারপর চোখের সামনে দেখছি বাংলা বিদ্যাচর্চা সম্পর্কে ছাত্র-শিক্ষকগবেষকদের মনোভঙ্গির বিবর্তন। দেখেছি কীভাবে মাতৃভাষার মৌলিক ব্যবহারবিধি সম্পর্কে উদাসীন থেকেও এবং নতুন পাঠগ্রহণ সম্পর্কে অনীহা দেখিয়েও বাহ্যিক অর্থে ‘সফল হওয়া সম্ভব। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই পাঠ্যসূচি চালু থাকলে শিক্ষকেরা স্বস্তিবোধ করেন এবং ছাত্ররাও খুশি থাকে। আর, সবচেয়ে বেশি সুখী হন সেই সব শিক্ষা-ব্যবসায়ীরা যাদের বাড়িতে এখন তিনবেলা বেসরকারিকরণের সুপবন বয়ে যাচ্ছে। একই কুমিরের ছানা দেখাতে দেখাতে তাদের দোতলা-তেতলা বাড়ি হয়, গাড়ি হয়, জৌলুস হয়, সামসুং-ভিডিওকনের জেল্লায় ঘরের চেকনাই বাড়ে। তাই পাঠ্যসূচি বদলানোর আশঙ্কা দেখা দেওয়া মাত্র এঁরা শোরগোল তোলেন, নানা অজুহাতে পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় বাধা দেন। কারণ, স্কুল-কলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে এঁদের কাছে নতুন পাঠ্যক্রম মানে কেঁচে গণ্ডুষ করা যা কিনা তাদের বিবেচনায় অকারণ পণ্ডশ্রম। এঁদের একমাত্র নীতি হল; ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।

 আসলে অধিকাংশ শিক্ষক এবং ছাত্রের কাছে পাঠ্যসূচি মানে কয়েকটি নির্দিষ্ট বই নয়, এদের প্রকৃত অর্থ হল মান্ধাতার আমল থেকে চলে-আসা কয়েকটি নির্দিষ্ট টপিক যাদের মধ্য থেকেও আবার চূড়ান্ত বাছাই করে কয়েকটি ছাঁচে-ঢালা প্রশ্ন পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার জন্যে তৈরি করা হবে। এবছর রাম এল তো ওবছর শ্যাম। থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাঁড়ি কমা পর্যন্ত বদলায়। এভাবে নতুন চিন্তা করতে অস্বীকার করে এবং পড়ানোকে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে ছাত্রেরা তথাকথিত টেক্সট বই পর্যন্ত পড়ে না এবং রেফারেন্স বই-এর নাম পর্যন্ত না-জেনে পরীক্ষা-বৈতরণী দিব্যি পেরিয়ে যায়।


 পরীক্ষক এবং অধ্যাপক নিযুক্তির প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকার ফলে আমার কিছু কিছু বোধোদয় হয়েছে। কী বরাক উপত্যকায় কী পশ্চিম বাংলায়, পরীক্ষায় পাওয়া মার্ক্স আর কোনোভাবেই জ্ঞানের পরিমাপক নয়। শতকরা পঞ্চান্নের বেশি নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যেও দশ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্যও ভালোভাবে জানে না। নেট’ এবং শ্লেট’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্যে কুইজের উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিতে ওরা যান্ত্রিকভাবে কিছু কিছু তৈরি হয় বটে, কিন্তু এর বাইরে গেলেই অথৈ জল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কারো কারো কাছে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত যুগ-বিভাগ পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের মতো বিখ্যাত লেখকদের দশটি বইয়ের নামও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারে না। অন্য

৪০