পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লেখকদের কথা ছেড়েই দিলাম। গত দশ-পনেরো বছরে প্রাতিষ্ঠনিক বাংলা বিদ্যাচর্চার যেসব বইপত্র বেরিয়েছে, তাদের সম্পর্কে কোনো কৌতূহল নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক সৃজনশীল সাহিত্যের কথা না তোলাই ভালো। আধুনিকতা বা রেনেসাঁস বা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলি সম্পর্কে ধারণা খুব ভাসা-ভাসা এবং নিতান্ত অগোছালো। এ এক ভয়াবহ সংকটের ছবি।

 কিন্তু এইজন্যে শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের একতরফা ভাবে দায়ি করলে চলবে না। পাঠ্যসূচিকে যতক্ষণ সময়গাপযোগী না করা হচ্ছে এবং পরীক্ষার প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি আমূল পাল্টানো না হচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা, পরিবর্তন-বিমুখ শিক্ষক-সমাজকে তাদের জাড্য থেকে বের করে আনা না হচ্ছে—অন্তত ততদিন বাংলা বিদ্যাচর্চার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আরো একটি জরুরি কথা সরাসরি ও কর্কশভাবে বলে নেওয়াটা প্রয়োজন। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগে যে অজাচার চলেছে, তা আগামী প্রজন্মের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কিছু নয়। শিক্ষকতার সঙ্গে ভাবাদর্শ ও সামাজিক দায়বোধের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার বড় কারণ, আমলা-মন্ত্রী-রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিয়ে শিক্ষকতার চাকরি কিনে নেওয়া হচ্ছে। এরা ছাত্রদের কী পড়াবে? বরং একথা লেখা যেতে পারে, ভুল পড়ানোর চেয়ে না পড়ানো অনেক ভালো। যোগ্য ব্যক্তিদের বঞ্চিত করে অযোগ্য ব্যক্তিরা প্রতাপশালী মহলের সুপারিশে সর্বোচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ছে। যোগ্য ব্যক্তিদের তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা নিশ্চয় অপরাধ; কিন্তু যে-পদ কোনো অযোগ্য ব্যক্তির প্রাপ্য নয়, তাকে তা পাইয়ে দেওয়া আরো বেশি অপরাধ। কেননা এ ধরনের শিক্ষক নামধারী ব্যক্তিরা বিদ্যাচর্চার ধার ধারে না। তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে সন্ধান করলে দেখা যাবে, এদের জীবনের ত্রিসীমানায় লেখাপড়া ও গবেষণা নেই। কিন্তু এইসব ব্যক্তির ছিদ্রপথেই বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বেনোজল ঢুকে যায়, এদের রাহুগ্রাসে নৈরাজ্য ক্রমশ শক্তিশালী হয়। এরাই ঈর্ষা-অসূয়া-বিদ্বেষ ও চক্রান্তের চোরাবালি তৈরি করে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এদেরই ক্লেদাক্ত উপস্থিতির জন্যে ছাত্র-ছাত্রীরা চিরকালের মতো প্রকৃত বিদ্যার উত্তাপ ও আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।

 স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকতার কাজে যুক্ত থাকার ফলে লক্ষ করেছি, নিচু স্তরে এখন আর ব্যাকরণ পড়ানো হয় না। বাংলা ভাষার প্রাথমিক বিধিগুলি। -জানার ফলে প্রতিটি স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংক্রামিত হয় অমার্জনীয় গুরুচণ্ডালি দোষ, বানান সম্পর্কে হাস্যকর অজ্ঞতা এবং পদান্বয়ে—গুরুতর ত্রুটি। বেছে বেছে। পড়ানোর ফলে ভাষার কাঠামো কিংবা সাহিত্যের তাৎপর্য সম্পর্কে কোনো উপলব্ধিই তৈরি হয় না। বিদ্যালয় স্তরে অজস্র বিচ্যুতি যখন অভ্যাসের অঙ্গ হয়ে পড়ে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেইসব শুধরে নেওয়ার আর কোনো উপায়ই থাকে না। বরাক উপত্যকার বাঙালি হিসেবে আমাদের কিছু বিশেষ সমস্যা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারার সঙ্গে যারা যুক্ত, ওই সমস্যার গভীরতা কখনো তারা বিশ্লেষণ করেননি বা সমস্যা থেকে উদ্ভূত সংকটের নিরসন করার কথাও

৪১