পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কালবেলার কথকতা

 যা অবধারিত, তা-ই হলো। রাঘববোয়ালের রাক্ষুসে খিদেয় মুছে গেল আরেকটি পুঁটি মাছের অস্তিত্ব। শক্তের ভক্ত এই দুনিয়ায় অনেকেই তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করল এই মনোরম দৃশ্য। যে-পথে গেছে আফগানিস্তান কিংবা তারও আগে যুগোশ্লাভিয়া বা চেকোস্লোভাকিয়া নামে প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সে-পথেই গেল ইরাক। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ধারাবিবরণীর উত্তেজনাও নেই আর। যাদের ড্রয়িং রুমে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ভালো বিকল্প তৈরি হয়েছিল, তাদের এখন সময় কাটতে চায় না। উত্তর কোরিয়া নামক গোকুলটি তৈরি হচ্ছে, সিরিয়া-ইরানে উনুন গরম হয়নি এখনো; রুটি সেঁকার কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি আসেনি। এখন ইরাকে লুটপাটের চাটনি আর সিয়া-সুন্নির ঝগড়ার পায়েস চেটেপুটে খাওয়া যেতে পারে।

 বুশ-ব্লেয়ারের যুগলবন্দি সেলিম-জাভেদ কিংবা লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের চেয়েও বক্স অফিসে ঢের বেশি হিট করেছে। নইলে আমাদের এই ভারতবর্ষের প্রান্তিক উত্তর-পূর্বের আধা-নাগরিক শহরেও ভাড়াটে কলমচিদের হুক্কা হুয়া এত স্পষ্ট হয়ে উঠত না। বিশ্বায়নের এমন চমৎকার সঙ্গত কোকাকোলা-পেপসির হিজড়ে-সেনারাও করতে পারেনি। মার্কিন প্রভুর নেকনজরে পড়ার জন্যে কী ব্যাকুল সম্পাদকীয়, সংবাদ পরিবেশনের কী বাহার! সাদা-চামড়ার মালিকেরা যদি কখনও বাতাসা ছুঁড়ে দেয়, এই আশায় বুক বেঁধে নিজেদের বাদামি-চামড়ায় নির্লজ্জ দাসত্বের, আত্মবিক্রয়ের শ্বেতীও প্রসাধন হিসেবে গ্রহণ করেছে এরা। সি.এন.এন, বি.বি.সি-র স্বেচ্ছানিযুক্ত ভাষ্যকার হিসেবে আগাগোড়া বজায় রেখেছে হুক্কা হুয়ার ঐকতান।

 অথচ পাশাপাশি তখন দেশে দেশে, এমনকী, বুশ-ব্লেয়ারের আপন ভূমি নিউইয়র্ক-ওয়াশিংটন-শিকাগো-লণ্ডনেও হাজার হাজার যুদ্ধবিরোধী মানুষ সভ্যতা-গ্রাসী সংস্কৃতিগ্রাসী নব্য সাম্রাজ্যবাদের দানবিক হিংস্রতার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। কিন্তু ইতিহাস ও মনুষ্যত্বের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে যে বেপরোয়া দাম্ভিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদীরা, তাদের কাছে জনগণ অর্থহীন। শিঙে বসে-থাকা মশা-মাছিকে যতখানি তাচ্ছিল্য করে ষাঁড়, তার চেয়ে ঢের বেশি অবজ্ঞা দেশ-বিদেশের যুদ্ধবিরোধী জনতাকে করেছে ওই ঘৃণিত পিশাচেরা। ওদের চাই ইরাকের অঢেল তেল-সম্পদ, যে করেই হোক! এইজন্যে ওরা মিথ্যার পাহাড় গড়েছে, রাষ্ট্রসকে ছেড়া ন্যাকড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলেছে আস্তাকুঁড়ে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নতুন পর্যায় শুরু করেছে অস্ত্রহীন অসহায় ইরাকের ওপর যথেচ্ছ মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। ইঙ্গ-মার্কিন জল্লাদের হানাদারি শুরু হওয়ার আগে ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া-চীন যতই ঘেউ ঘেউ করুক, এখন তাদের গলায় মিনি বেড়ালের মিহি মাও-মাও। ইরাকের শবদেহের

৪৪