পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তারাই শত্রু। তার মানে, এই একুশ শতকে কোথাও কোনো অপর পরিসর বা সমান্তরালতা থাকবে না, থাকতে দেওয়া হবে না কোনো দ্বিরালাপের সম্ভাবনা। ভিন্নমত পোষণ করার মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃত হবে না এই নতুন বিশ্বে। বিশ্বায়ন মানে মার্কিনীকরণ, আরও চাঁছাছোলা ভাষায় বলা যায়, বুশীকরণ বা বুশায়ন। ওবামার জমানা এরই ধোপদুরস্ত সংস্করণ। রবীন্দ্রনাথ যে মানববিশ্বের বয়ান পেশ করেছিলেন, এই বুশীকরণ প্রক্রিয়া রয়েছে ঠিক তার উল্টো মেরুতে। এ হলো দশমাথা বিশ হাতওয়ালা রাবণের নীতি; দুনিয়ায় যেখানে যত সম্পদ রয়েছে, সব কিছুতে বুশ ও তার উত্তরসূরির সাঙ্গপাঙ্গদের অধিকার শুধু। বহুজাতিক সংস্থার শুড় দিয়ে সব রস শুষে নেওয়াকে যারা বিরোধিতা করবে, তারাই কোতল হবে। কোতল করার আগে শত্রুদের মুখে মাখিয়ে দেওয়া হবে চুনকালি; অজস্র বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম সহ সমস্ত ঢোল-শহরতের ওপর কজা বুশ-পাওয়েলদের। দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে এদের জুড়ি নেই, গোয়েবলস্ এদের খাস কংসমামা। অতএব ইরাকের সম্ভাব্য বার্ষিক তেলসম্পদ (এই মুহূর্তে গোমস্তা সৌদি আরবের তুলনায় পৃথিবীতে দ্বিতীয় হলেও সমস্ত উৎসকে কাজে লাগালে প্রথম হতে পারে) (তিরিশ হাজার কোটি ব্যারেল) নিঙড়ে নেওয়ার জন্যে সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে গেছে। এখনও চলছে চোঁয়াঢেঁকুর।

 মূল মন্ত্র হল পরিচিত সেই ইংরাজি প্রবাদ: কুকুরকে মেরে ফেলার আগে তার বদনাম করো। বুশ-ব্লেয়ারের তিনটে ধারণা খুব বদ্ধমূল; এক, জনতার চেঁচামেচিতে কান দিলে বড়ো কাজ করা যায় না; দুই, জনতার স্মৃতি খুব দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী; তিন, উত্তেজক ও ভীতিকর কিছু গুজব ছড়িয়ে দিলে কেল্লা ফতে। এই তৃতীয় নীতি অনুযায়ী আফগানিস্তানকে শায়েস্তা করার সময় অ্যানথ্রাক্স আর ইরাকের টুটি টিপে ধরার সময় সার্স-এর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে বুশ সাহেবের চেলারা। বুশায়ন মানে, কেউটে হয়ে ছোবল দাও এবং ওঝা হয়ে ঝাড়তে আসসা। কিংবা, একই অসুখে দুটো আলাদা দাওয়াই দাও। তাই আফগানিস্তান থেকে সমাজতান্ত্রিক চেতনার মূলোলাচ্ছেদ করার জন্যে ধর্মান্ধ তালিবানদের তৈরি করেছে মার্কিন প্রভুত্ববাদ; মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাষ্ট্রগুলিতে জন্ম দিয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে, পরে আরব জাতীয়তা ও ইউরোর সম্ভাব্য সম্পর্ককে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্যে ঝি-কে মেরে বউকে শেখাতে চেয়েছে। গত শতকে ইরাক-ইরানের যুদ্ধ লাগিয়েছিল কারা? ঐ মার্কিনীরা। ইরানের সম্রাট কাদের প্রশ্রয় পেয়েছিল, খোমেইনি কাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ দেখছে? এই প্রতিবেদন যখন লিখছি, ইরাকে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছক তৈরি হচ্ছে কাদের উৎসাহে? আফগানিস্তানে ছিল সন্ত্রাসবাদ ও মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইরাকের সাদ্দাম তো লাদেনের মতো পৃথিবীর কোথাও সন্ত্রাসবাদ রপ্তানি করেননি। সাদ্দামের প্রধান বিরোধী দল ছিল আল-কায়দার ঘনিষ্ঠ ইনসাফ-আল-ইসলামি নামে সংগঠন। তাহলে? সাদ্দামের ইরাকে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত ছিল, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক পুনর্গঠনের নামে ওখানে এখন

৪৭