পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মধ্যযুগের অন্ধকার ফিরে আসবে। আর, তা ঘটবে যুদ্ধোন্মাদ রক্তচোখ ড্রাকুলার হিংস্রতম অবতার বুশ ও ওবামা সাহেবের প্রত্যক্ষ মদতে। সাদ্দাম যদি একনায়ক, বুশ তবে কী? কদিন আগে জানা গেছে, খোদ মার্কিন মুল্লুকে যুদ্ধবিরোধী জনতার প্রতিবাদে বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ ‘গ্রেট ডিক্টেটর’ ভাবছে, পাজি বেয়াদবদের কিছু কিছু গঠনতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করা যেতে পারে।

 এই তো ছিল বুশের গণতন্ত্র যেখানে গণ নেই ঘাতকতন্ত্র আছে শুধু। বুশের বন্ধুদের সর্বাঙ্গ গলিত হলেও বাধা নেই; অবশ্য মার্কিনী অভিধানে বন্ধুত্ব পদলেহনের মর্যাদাপ্রাপ্ত। যেমন পাকিস্তানের শাসক পারভেজ মুশারফ কিংবা বেনজির-পতি জারদারি। আফগানিস্তান-বসনিয়া সহ নানা দেশে যারা হাজার-হাজার সাধারণ মানুষকে খুন ও সর্বস্বান্ত করে, সারা জীবনের মতো পঙ্গু, ভিখিরি ও উদ্বাস্তু করে, তাদের মতামতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পুতুল সরকার বসিয়েছে, তাদের পালের গোদার মুখে ‘গণতন্ত্র ভূতের মুখে রাম নাম ছাড়া আর কী? এই গণতন্ত্র হল এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার পর্যায়ে প্রভুত্ববাদীর হাতের তাস। এর মূল নীতি সুকুমার রায়ের ছড়ার ভাষায় এরকম: ‘আমরা খাব মণ্ডা-মিঠাই/আমরা খাব চমচম/তোমরা সে-সব পাবে না কো/পেলেও পাবে কমকম। তাই তো মার্কিনীদের পরমাণু-অস্ত্র রাসায়নিক-অস্ত্র জীবাণু-অস্ত্র থরে থরে মজুত করতে বাধা নেই। কিন্তু ওইসব গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাক মজুত করছে বলে শশারগোল তুলে, রাষ্ট্রপুঞ্জের তথাকথিত পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়ে ইরাককে পিষে মারার অজুহাত তৈরি করতে অসুবিধে নেই। ইরাক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরেও কিছুই তো বেরোল না। তবু এই প্রশ্ন ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া-জাপান: কেউই করছে না, কোথায় গণবিধ্বংসী অস্ত্র? ঘোর সাদ্দাম-বিরোধী ইরাকি পরমাণুবিজ্ঞানী ড. ইমাদ খান্দুরি প্রবন্ধ লিখে জানিয়েছিলেন, ইরাকে হামলার পেছনে কোনো কারণ ছিল না। তবু নির্লজ্জতার বান ডেকেছে প্রভুত্ববাদের চাপরাশিদের মধ্যে। উলঙ্গ রাজার দিকে প্রকাশ্যে আঙুল তুলে যারা বলেছে ‘রাজা তুই ন্যাংটো’—তাদের কণ্ঠস্বর ডুবে গেছে ক্রুজ মিসাইলের ভয়ংকর বিস্ফোরণে।

 পেট্রোলিয়াম কোম্পানির মালিক বুশ পরিবার এখন আর উঁচ হয়ে ঢোকে না, সরাসরি ফাল হয়েই ঢোকে। ইরাককে মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার পরেও স্পর্ধিত ইরাকিরা হাজারে-হাজারে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন: ‘দখলদার বাহিনী, ইরাক ছাড়ো। এই প্রতিবেদন লিখতে লিখতে জানলাম, মার্কিনী সেনাপতি বলছে কভি নেহি। আরও অ-নে-ক দিন এদেশের কলকজা ঠিক করার জন্যে আমরা থাকব। হল্লারাজার আরও সেনা ঢুকছে ইরাকে। কেননা বেয়াদব ইরাকিরা বলছে, ইরাক আমাদের। আমরা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ চালাব! আসিরিয়া ও ব্যাবিলনের প্রত্নসম্পদ লুঠ হয়ে গেল; ইতিহাসকে প্রকাশ্যে ধর্ষণ করা হলো। ন্যায়-নীতি-মানবতাবোধ মাটিতে মিশে গেল। ডলার ও ইউরোর যুদ্ধ শ্বেতাঙ্গদের রুটি ও মাখনের লড়াই; উলুখাগড়ার প্রাণ গেল তাতে। হেনরি কিসিঙ্গারের কুখ্যাত বই ‘ডাজ আমেরিকা নিড এ ডিপ্লোম্যাসি’র সরল বীজগণিত আরও একবার বাস্তবে দেখা গেল। না, আমেরিকার কূটনীতি চাই না,

৪৮