পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

‘বাজে খাতা’ রয়েছে এই প্রবণতার বিপ্রতীপে। এই সংকলনগুলি বৃহত্তর বাংলা সাহিত্যের পুড়ুয়াদের হাতে যদি ঠিকমতো পৌছাত, নিঃসন্দেহে এই সত্য প্রমাণিত হত যে এপার বাংলা ওপার বাংলা ছাড়াও রয়েছে নির্বাসিত অপর বাংলা। তার লেখাপত্রে জীবনের মননের উপলব্ধিতে ভিন্নতর মাত্রা নান্দনিক বিচারেই সহযাত্রীর মর্যাদা পেতে পারে। এদের না-জেনে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা অপরাধ।

 ‘গল্পপঞ্চদশী' নামে লেখিকাদের একটি সংকলনও রয়েছে। নারী-পরিসর এতে কতখানি উপস্থিত, তা হয়তো তর্কের বিষয়। কিন্তু জীবনের ভেতরে রয়েছে আরেক জীবন, সেদিকে আমরা তাকাই কিন্তু দেখি না তাদের—এই বার্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এইসব গল্পকারদের বয়ান থেকে। ঝুমুর পাণ্ডে এই জগৎ-অন্তবর্তী জগতের সবচেয়ে জোরালো প্রতিনিধি।‘গেরাম থানের মেয়েটি ও দুলিয়া’ নামক গল্পসংকলনে বরাকের স্বল্প-আলোকিত সামাজিক পরিসরের টুকরো-ছবি পাওয়া যায়। এবছর শারদীয় দৃষ্টিপাত পত্রিকায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ঝুমুরের বিপরীত মেরুতে রয়েছে। স্বপ্না ভট্টাচার্যের ছোটগল্প। নারী-পরিসরের উন্মোচনে সচেষ্ট তিনি। বরাক উপত্যকার কথাসাহিত্য ক্রমশ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠছে এঁদের সমবায়ী উপস্থিতিতে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এখানে অবতারণা করা যায়। দেশবিভাগের রক্তাক্ত ক্ষত এবং সেই ক্ষত নিরাময়ের ব্যর্থ চেষ্টা: শুধুমাত্র এই বিষয়টি থেকে অসামান্য কিছু উপন্যাস রচিত হতে পারত এখানে। ছিন্নমূল মানুষের ঢল নেমেছিল এই উপত্যকায়; পূর্বপাকিস্তান থেকে এবং পরে আসামের ভাষাদাঙ্গায় দ্বিতীয়বার উদ্বাস্তু-হওয়া মানুষেরা এসেছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে। পায়ের নিচে জমি খুঁজে পাওয়ার লড়াই চালাতে গিয়ে উদ্বাস্তু-প্রজন্ম উৎখাত হল নৈতিকতার বোধ থেকেই। আধা-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে আপসের হাজার পথ খুলে যায়, ভাবাদর্শ অবান্তর হয়ে পড়ে। একদিকে পরিকল্পনাশূন্য নগরায়নের চাপ, অন্যদিকে সুবিধাবাদিতা ও সার্বিক অবক্ষয়ের চোরাবালি: ব্যক্তি-অস্তিত্বে না আছে কেন্দ্র, না আছে পরিধি। খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে যেমন আদি পাপ, ছিন্নমূল প্রজন্মগুলির জন্যে তেমনি দ্বিজাতিতত্ত্ব ও তজ্জনিত দেশবিভাগ। আজও মাথার উপর আকাশ নেই। তাই, পায়ের নিচে নেই জমি। ব্যক্তির বিচূর্ণায়ন এবং তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়ার দৃশ্য ও অদৃশ্য সংগ্রাম মহাকাব্যিক উপন্যাসের বিষয় হতে পারত।

 কেন হল না এতদিন: এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শেখর দাশ লিখেছেন তিনটে উপন্যাস; মোহনা, বিন্দু বিন্দু জল, রাঙামাটি। এদের মধ্যে ‘বিন্দু বিন্দু জল’-এ দেশবিভাগ ও উদ্বাস্তু-প্রজন্মের সার্বিক ক্ষয় উপন্যাসীকৃত হয়েছে। এর আগে কিছু কিছু বড়ো গল্পে উপন্যাসায়নের বিচ্ছিন্ন কিছু চেষ্টা হয়েছিল। মিথিলেশ ভট্টাচার্য, বদরুজ্জামান চৌধুরী, শেখর দাশ তা করেছিলেন। অতি সম্প্রতি অমিতাভ দেবচৌধুরীর উপন্যাসের খোজে’ প্রব্রজনের বহুমাত্রিক তাৎপর্যকে উপন্যাসের পদবি দিতে চেয়েছে। যেহেতু রচনা মাত্রেই লেখা’ নয়, দু-একজন পূর্বসূরির প্রয়াসকে এই বর্গের অন্তর্ভুক্ত করছি না। তবু এইসব দৃষ্টান্ত থেকে এটা নিশ্চয় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বরাক

৬৭