পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেতে পারেননি। স্থানীয় ও বহিরাগত—এই দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিচিত্র দ্বন্দ্বের ইতিবৃত্ত এখনও তেমন করে বিশ্লেষিত হয়নি। যদি হয় কখনও, দেখা যাবে, স্থানীয় মানুষ যেখানে বাংলা ভাষায়, কিংবা কোনও উপভাষায় কথা বলেন—সেইসব ক্ষেত্রেও বিড়ম্বনার শেষ নেই বাস্তুহীন মানুষের জন্যে। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিনিময়ের বদলে অদ্ভুত প্রতিরোধের মোকাবিলায় শক্তি ক্ষয় করতে হয়েছে তাঁদের। দীর্ঘ সংগ্রাম ও অধ্যবসায়ের পরে যখন এঁরা নতুন বসতি করেছেন, তখনও ‘উদ্বাস্তু, ইংরেজি-নবিশ বাচনে ‘রিফুজি’, বিশেষণ গায়ে লেগে রয়েছে ডাকটিকিটের মতো। এঁদের জন্যে বরাদ্দ হয়েছে শ্লেয-বিদ্রপ-তাচ্ছিল্য-অবহেলা-অপমান। আমরা এবং ‘ওরা’র বেড়া পাকাপোক্ত হয়েছে প্রতিটি নির্বাচনে। ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে এদের লোক-দেখানো কদর এবং সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে। সামাজিক সমস্যা অবধারিত ভাবে রূপান্তরিত হয়েছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যায়। দেশবিভাজন খ্রিস্টিয়দের আদি-পাপ এর মতো ছায়া ফেলে এখনও। কোনও দিন কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি, বাঙালি হয়েও বঙ্গভূমির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ থেকে কেন তাদের চলে আসতে হয়েছিল: সাধ করে কি কয়েক পুরুষের অর্জন ও অভ্যাস থেকে সরে এসেছিলেন তারা!

 কিন্তু যেখানে অন্যভাষার মানুষেরা রয়েছেন, সেখানে অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর, আরও বেদনাময়। আসামে বারবার বঙ্গালখেদা আন্দোলন হয়, নামটাই শুধু আলাদা। কতবার যে ঘর পুড়েছে আশ্রয়সন্ধানী বাঙালির, কতবার যে উদ্বাস্তু হয়েছেন তারা—এর কোনও ইয়ত্তা নেই। অপরাধ একটাই: এঁদের মাতৃভাষা বাংলা। কিছু কিছু পণ্ডিত গবেষক নিরাপদ ছোঁয়া-বাঁচানো দূরত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞজনোচিত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে গর্বোদ্ধত বাঙালির দখলদারি মনোভঙ্গিতে উত্যক্ত হয়েই নাকি বঙ্গালখোর মতো ‘স্বাভাবিক’ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এইসব বিজ্ঞজন অবশ্য এই খবর রাখার প্রয়োজনও বোধ করেন না যে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং মাতৃভাষায় পড়াশোনা করার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে গিয়ে শান্তিরক্ষক পুলিশের গুলিতে আসামের শিলচর শহরে শহিদ হয়েছিল কেউ কেউ। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো জন শহিদদের কথা পশ্চিমবঙ্গের সচেতন মানুষেরা জানতেন না এই সেদিন পর্যন্ত। গত চার-পাঁচ বছর ধরে এই দিনটি উদ্যাপন করছেন কেউ কেউ। তার আগে পর্যন্ত ‘ভাষাশহিদ দিবস’ বলতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বুঝতেন শুধু ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে। আসামে যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি থাকেন, কলকাতা-কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা পর্যন্ত এর হদিশ জানতেন না।

 আমাদের বাংলা ভাষা যে শুধুই মান্য চলিত নয়, এ ভাষায় রয়েছে অজস্র লোকায়ত বিভঙ্গ—প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভাষী মানুষজনের বসতভূমিতে, জেলায় জেলায় মহকুমায় মহকুমায় ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে যায় বলে উপভাষা-বিভাষার সমৃদ্ধি অতুলনীয়—এখবর রাখেন না পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গেই বীরভূম-পুরুলিয়া-মুর্শিদাবাদ-মালদহ-কোচবিহারে কত না উপভাষার লাবণ্য-বিহার! আসামে-ত্রিপুরায় এবং অবশ্যই বাংলাদেশের জেলায়-উপজেলায় বাঙালির

৭১