পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাল্টে নিয়েছে। রাষ্ট্রবিপ্লবে ছিন্নমূল বাঙালিদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের আদমসুমারিতে নব-অসমিয়া বলে দেখিয়েছে। একুশ শতকের প্রথম আদমসুমারিকে ওরা আরো বেপরোয়া ভাবে অসমিয়াকরণের কাজে লাগিয়েছে নাৎসি কায়দায়। বরাক উপত্যকার রক্তের মূল্যে বাঙালিরা মাতৃভাষার মর্যাদা আপাতত রক্ষা করতে পারছে। কিন্তু সেখানেও সরকারি মদতে খিড়কিদুয়ার দিয়ে অসমিয়া চাপানোর চেষ্টা চলছে; পাঠ্য বইগুলিতে সরকারি পুস্তক পর্ষদের ভাড়াটে কলমচিদের দিয়ে অসমিয়া শব্দ, বাকবিধি ও নিম্নমানের বিষয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। ফলে বাঙালি শিশু-শিক্ষার্থীরা তাদের ভাষা-চেতনাকে ঠিকমতো বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছে না। বরং ভুল ভাষারীতি শিখছে বানানে। বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলার বদলে তাদের ভাষা-মনস্তত্ত্বকে পঙ্গু ও বিকৃত করে দেওয়া হচ্ছে।

 বাঙালিরা পরস্পর সম্পর্কে যত উদাসীন, নিরাসক্ত ও আত্মঘাতী কুযুক্তিতে আস্থাশীল—তত আর কেউ নয়। ঐতিহাসিক কারণে দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বলি বাঙালিরা শতচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রুটি-মাখন নিয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারার লড়াই হল, তার ফলে বহু লক্ষ বাঙালি সাত প্রজন্মের ঘর হারাল। ঘরের সঙ্গে হারাল সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের জমি ও আকাশ, বিশ্বাস-স্থৈর্য-সংলগ্নতাবোধের আলো-হাওয়া-রোদ। তবু, তখনও শেষ হল না স্রোতের শ্যাওলা হয়ে ভেসে যাওয়ার যন্ত্রণা। আসামে-আন্দামানে-দষ্কারণ্যে মেঘালয়ে-মরিচঝাপিতে-দিল্লিতে বারবার বাঙালিকেই কেন ধনে-জনে-প্রাণে বিপন্ন হতে হয়? শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলে, এই অপরাধে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীন পুলিশ বাহিনী নিছক অসমিয়া সম্প্রসারণবাদীদের প্ররোচনায়, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে সত্যাগ্রহরত তরুণ-তরুণীর উপর গুলিবর্ষণ করেছিল আসামের শিলচরে। ১১ জন শহিদ হয়েছে। মাতৃভাষার জন্যে, ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনার পরে এই দ্বিতীয়বার। সেখানেই কিন্তু ইতিহাস থেমে যায় নি। বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট একজন এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই আরও দুজন বাংলা ভাষার উপর নিগ্রহ রুখতে শহিদ হয়েছেন। তবু, হায়, বাঙালিদের মধ্যেই এমন অনেকে আছেন যাঁরা বরাক উপত্যকার আত্মিক অভিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানেন না, জানতে চান না। এ অঞ্চল যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের চক্রান্তে ১৮৭৪-এ এবং পরে ১৯৪৭-এর গণভোটে প্রভুত্ববাদীদের ধূর্ত কৌশলে বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল—তার প্রথমটার খবর রবীন্দ্রনাথ জানতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নামে অজ্ঞান হয়ে-যাওয়া বঙ্গজনেরা জানেন না। জোর করে বরাক উপত্যকাকে আসামের লেজুড় করে দেওয়া হলেও ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক-ভৌগোলিক-ভাষিক নিরিখে বরাক উপত্যকা বৃহত্তর বঙ্গভূমির (সাম্প্রতিক বিহার, পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে) অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতএব এখানকার বাঙালিদের মধ্যে বাংলা ভাষার বিপন্নতা তার ভাষিক-আস্তিত্বিক-রাজনৈতিক সত্তার সংকটেরও অভিব্যক্তি।

 ইতিহাসের বয়নে নানা ধরনের অন্ধবিন্দু থাকে। কখনও তাদের প্রশ্রয় দিই আর

৮০