পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ভাষা-নীতি-ধর্ম-সংস্কৃতি-ভাবাদর্শ: সমস্তই আপেক্ষিকতার বুদ্বুদ এবং অধিপরিসরে প্রতীত ধারণামাত্র, সেই আধুনিকোত্তর প্রতিভার পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে মানবিক স্বভাবে দীপ্যমান থাকার জন্যে নতুন লড়াই শুরু করতে হচ্ছে। এ সময় যারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মতন্ত্রের জিগির তোলে, তারা কুচক্রী। ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালিরা বাংলা ভাষায় জীবনস্পন্দন অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে ওই লড়াই শুরু করুক ওই কুচক্রীদের জমায়েতের বিরুদ্ধে। এছাড়া অন্য পথ নেই কোনো।

 বিশ শতকেও বাংলা ভাষার একটা লড়াই ছিল। বস্তুত ছিল উনিশ শতকেও। কিংবা, আঠারো ও অন্যান্য শতকে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে এর স্বরূপ আলাদা। সমাজের বিয়োগ পরিস্থিতি যেমন বিপন্নতার স্রষ্টা, তেমনই নিষ্ক্রমণের তাগিদও সমাজের মধ্যে তৈরি হয়। ভাষা-প্রয়োগের ধরন বদলে যায় কখনও, নতুন উপকরণ যুক্ত হয় কখনও বা। সর্বদা এই রূপান্তর দৃশ্যগ্রাহ্য হয় না কেননা ভাষার ছায়াতপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সবচেয়ে বড় কথা, অর্থবোধ হওয়ার পদ্ধতিও বিনির্মিত হয় মূলত ভাষার সংযোগ সম্ভাবনাকে আরও শানিত ও প্রসারিত করার জন্যে। সংযোগ-ক্ষমতা শিথিল বা রহিত হওয়ার আশঙ্কাই তো ভাষার সবচেয়ে বড়ো বিপন্নতা। কখনো ভেতরে কখনো বাইরে আর কখনো একসঙ্গে ভেতরে ও বাইরে ওই বিপন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা তাই স্বতশ্চলভাবে ভাষায় শুরু হয়। বিশ শতকের ঔপনিবেশিক আধুনিকতা তুঙ্গ মুহূর্তে পৌছাল, তারপর ক্রমশ দেখা গেল তার অবক্ষয়ী প্রবণতা। বাংলা ভাষার প্রয়োগে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ নন শুধু, আরও বেশ কয়েকজন বাচনিক স্রষ্টার অসামান্য দক্ষতা দেখতে পেলাম তখন। দেখলাম বৃত্তবন্দিত্ব আর অবসাদও।

 এবার বিশ্বায়নের সূত্রে এসেছে নতুন প্রত্যাহ্বান, নতুন বিপন্নতা। একটু আগে যেমন লিখেছি, বাংলা ভাষাকে এদের মোকাবিলা করার জন্যে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে নিজেরই মধ্যে। একটুখানি কি ঔচিত্যের স্বর এসে গেল? সম্ভবত ভাষাপ্রয়োগের নিরন্তর পুনর্বিন্যাসে অনিবার্য তার উপস্থিতি। মানববিশ্ব অভূতপূর্ব আক্রমণের মুখোমুখি বলেই ভাষা দিয়ে নির্মানবায়নের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে হবে এখন। চতুর শত্রু তাই আমাদের নিরস্ত্র করতে চাইছে ভাষা-স্বভাবকে ধ্বংস করে দিয়ে। সর্বগ্রাসী বিয়োগপর্বের সাম্প্রতিক এই গোলকধাঁধায় নিক্ষিপ্ত হয়েও বলব, ভাষা অদাহ্য, অনির্বাণ। যখন পুরনো সব সংকেত ভোতা হয়ে যায়, ভাষা নিজেই নিজের কোরকগুলি মুকুলিত করে। একুশ শতকের অধিপরিসরে হয়তো তার আত্মখননের পদ্ধতি অভাবনীয় হতে পারে, এইমাত্র।

 বিপন্নতার নতুন নতুন ধরন দেখা দিচ্ছে, দিক। মানুষের নির্যাসবাহী ভাষা পাল্লা দিক তার সঙ্গে, হয়ে উঠুক সেরা অস্ত্র, যা একই সঙ্গে লক্ষ্যসন্ধানী ও লক্ষ্যভেদী।

৮৫