পাতা:সময় অসময় নিঃসময় - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যে ভাষাপ্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত পুনঃশিক্ষিত হতে হয়—প্রতাপের ছায়ায় লালিত হয়ে এঁরা এই সত্য ভুলে যান। শেষ পর্যন্ত মনস্তাত্ত্বিক কারণে এঁরা বাংলা ভাষাকেও নিজেদের সেবাদাসী বলে ভাবতে শুরু করেন। মুশকিল হচ্ছে, রোজ এদের কলম-নিঃসৃত বাক্যরাশি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। জনসাধারণের ভাষারুচিকে এরা দলিত, মথিত ও বিকৃত করে দিচ্ছে। কেউ দেখার নেই, কেউ বলার নেই। আর বললেই বা শুনবে কে? এই যে বিচিত্র পরিস্থিতি, তা-ও প্রান্তিক অঞ্চলের উপভাষায় আনখশির প্রোথিত থাকার ফলেই উদ্ভূত হচ্ছে। আলোর চেয়ে ছায়ার রমরমা যেখানে, স্বভাব সেখানে আচ্ছন্ন হয় সহজে: জাতীয় স্বভাব, ভাষার স্বভাব, অনুভূতির স্বভাব—সর্বত্র সুস্থতার চেয়ে বিকার বড় হয়ে ওঠে। চিন্তা ও উপলব্ধিতে কেন্দ্র নেই কোনও, আছে কেবল লাগামছাড়া বয়ে যাওয়া। আছে ‘ঠেকার কাজ’ কুলিয়ে দেওয়া। উপভাষার শৌর্য ও সৌন্দর্য, প্রাকৃতায়নের স্পন্দন যেখানে বাচনে অভূতপূর্ব গভীরতা যোগ করতে পারত, সেখানে তার বদলে দেখা যায় উপসংস্কৃতির লঘুতা ও হীনমন্যতা। দুঃখিনী বর্ণমালার অষ্টাবক্র দশা তাই অবধারিত।

 অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদের বিষক্রিয়ার অভিব্যক্তিগুলি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ‘বৈশিষ্ট্য বলে বন্দিত ও অনুকরণীয় হয়ে ওঠে। সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের সঙ্গে এইসব অভিব্যক্তির দ্বিবাচনিক সম্পর্ক বিচার না করে যখন তাদের মান্যতা দেওয়া হয়, বুঝতে হবে এ কেবল জাতে ওঠার মেড ইজি বা সহজ পাঠ মাত্র। যা আমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করিনি, তা প্রসাধনের বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। আমাদের এই অনাগরিক উপভাষা-অঞ্চলে প্রাকৃতায়ন, ঐতিহ্যমনস্কতা, আদিকল্প থেকে আহৃত চেতনা, ধীরস্থির নিসর্গসাপেক্ষ চিহ্নায়ন প্রকরণের গ্রন্থনা কেবলমাত্র সাহিত্য ও শিল্পসৃষ্টির লক্ষণমাত্র নয়; এ আমাদের জীবনদৃষ্টির বিশিষ্ট ধরন। যেসব অপরিহার্য কারণে এবং কেন্দ্রীকৃত প্রতিবেদনের আধিপত্যবাদী তাড়নায় শিষ্ট চলিতভাষী এলাকায় ঔপনিবেশিক আধুনিকতাবাদের আদল ক্রমশ আদর্শায়িত হয়েছিল, উপভাষাভাষী বরাক উপত্যকার বাঙালিদের জন্যে সেসব কিছুমাত্র প্রাসঙ্গিক ছিল না। তবু বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজেদের ব্রাত্য লঘুসংস্কৃতি কিংবা উপসংস্কৃতির অনুসারী বলে ভেবেছি বলে আমরা জন্মসূত্রে অর্জিত এবং অভিজ্ঞতায় ও উপলব্ধিতে পুনঃস্বীকৃত অভিজ্ঞানকে পশ্চাৎপরতার দৃষ্টান্ত মনে করে মরমে মরে রইলাম। নিজেদের বিকল্প জীবনবীক্ষার নিবিড়তা, লাবণ্য ও গৌরবের তাৎপর্য আবিষ্কার করার বদলে বহু হাত-ফেরতা আধুনিকতাবাদের উদ্ভট রঙ মেখে নিলাম। গাজনের হরগৌরীর মতো নয়, সাকার্সের ক্লাউনের মতো। অথচ উত্তর আধুনিকতার ফসল গোলায় ভোলার মতো ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত, শ্রাবণের মেঘ নিয়ে আকাশ ছিল উন্মুখ, উপভাষার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য লোকায়ত ঐতিহ্যের বীজতলি ছিল আগ্রহী কৃষকের অপেক্ষায়। আমাদের কবিতায় ও ছোটগল্পে মাঝে মাঝে তার ঝিলিক দেখা গেল শুধু। কিন্তু অবক্ষয়ী আধুনিকতাবাদ আমাদের শেখাল আত্ম-অবমাননা, স্বভূমির প্রতি উপেক্ষা, মিথ্যা কেন্দ্রীকরণের প্রতি মোহ। আর, হাল আমলে আধুনিকোত্তর প্রতিজগৎ ও প্রতিচেতনার

৯০